টিকোইল গ্রাম

শিল্পীর বসত, টিকোইল গ্রাম

শিল্পীর বসত, টিকোইল গ্রাম

ডঃ সাজিদ বিন দোজা বনি

বরেন্দ্রভূমির ঐতিহ্য হাজার বছরের; সেই সুপ্রাচীন কাল থেকে এই অঞ্চল ঐতিহাসিক পটভূমির বর্ণিল এক উপাক্ষান। বদ্বীপ সভ্যতার অন্যতম জনপদ ও নদী মাতৃক শহর এর একক সন্নিবেশন এই অঞ্চলে মহাকালের প্রজ্জলিত দৃষ্টান্ত স্থাপন করে। টিকোইল গ্রাম

গঙ্গা,পদ্মা আর মহানন্দার বিস্তর প্রবাহ এই অঞ্চলকে আবহমান কাল থেকে উজ্জীবিত রেখেছে। সভ্যতা আর সংস্কৃতির অনন্ত ধারাকে বহমান রাখার অভিপ্রায় এ প্রাচীন জনপদের।

ইতিহাসে কখনই প্রাসাদ দূর্গের বাইরে জনসাধারন বা প্রজাদের সমাজ জীবনের দর্পণ কেমন ছিলো তা লেখা হয়নি, তা রয়ে গিয়েছে অজানা। অজানা তাদের কীর্তি, অর্জন আর দুঃখ দুর্দশা। সেই ইতিহাস আমাদের পূর্বপুরুষগণ লেখেননি। দখলকারী বা বিদেশীরা লিখেছেন। কত যে বর্ণিল, রাঙা আর আবীর মুখর এই এলাকার আবাসন, প্রথা ও আচার আচারন ছিলো তা সত্যই দুর্লভ ও পতিত।

শিল্পীর বসত, টিকোইল গ্রাম

এই জলজ ভূখণ্ডের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সাংস্কৃতির বহমান ধারা সজীব ও অতি সমৃদ্ধন। সমসাময়িক এবং বৈজ্ঞানিকতার কিছু ছিটেফোঁটা আজত্ত দৃশ্যমান এই বরেন্দ্র জনপদে। সত্যিই বটে, এই এলাকায় মাটির ঘরের একপ্রকার বৈশিষ্ট্য তো আছেই এবং এর সাথে তাল ও সুর মিলিয়েছে চিত্রকলার অনবদ্য ভাণ্ডার। মাটির দেওয়ালগুলো যেন শৈল্পিক অবদানে ভরপুর। দেওয়াল গুলো যেন জীবন্ত হয়ে উঠেছে কারো তুলির জাদুময়ী আঁচড়ে।

টিকোইল গ্রাম
টিকোইল গ্রাম

চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার নাচোল উপজেলায় ছোট্ট একটি গ্রাম টিকোইল, গ্রামটির প্রবেশেমুখে প্রথমেই স্বাগত জানাবে বর্ণিল সব বসতভিটা। কি দূর্দান্ত সব শৈল্পিক সৃষ্টি, রংবেরঙের নকশা আর আলপনা। বাসার মহিলারা সুনিপুণ ভাবে তুলির আঁচড়ে পরম্পরার বহমান ধারাকে সমুন্নত রেখেছে। প্রাকৃতিক উপায়ে তৈরী করা বিভিন্ন উজ্জ্বল রঙের ছোপ এক অভূতপূর্ব পরিসরের অবতারনা ঘটায়।


শিল্পের এই কমল ছোঁয়ায় ছোট্ট এই জনপদের মানুষদের বিশেষ শিল্পশৈলী প্রতিদিন অনুপ্রানিত করে, শুরু হয় অন্তর্নিহিত এক প্রাণশক্তির উচ্ছ্বাস থেকে। বাঁচিয়ে রাখে শিল্পের সান্নিদ্ধে। গ্রামটির পূর্বপুরুষেরা এই শিল্পশৈলীর ধারা আবহমান কাল ধরে চর্চা করে এসেছেন। বংশধরেরা তার প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করার মাধ্যমে এই রীতি নীতি আজও ধারণ ও লালন করছেন। ঠিক বিশেষ কোন দিনের জন্য এ কার্যসাধন করা হয় না। নিজেদেরকে প্রানবন্ত আর উৎসবমুখর রাখার জন্য এই প্রয়াস। কারন এ শিল্প-সাধনা আসলে ঈশ্বরের আরাধনা করা, তারা বিশ্বাস করেন।

টিকোইল গ্রাম
লেখকের শৈল্পিক চোখে টিকোইল গ্রাম

একই সাথে আলোছায়ার প্রকৃতিগত গুণ অঙ্কিত মাটির দেয়ালে যখন অবগাহন করে তখন অপার্থিব একলোকের জন্ম নেয়, যা ব্যাখ্যা করা অতি দুষ্কর। টিকোইল গ্রামের শিল্পীরা মাটির দেয়ালে তাদের পরম্পরায় এক ধ্রুপদী চিত্র আঁকে।

 

টিকোইল গ্রাম – সুপারিশ

আমি মনেকরি এটি কোন সহজ সরল আলপনা নয়, নকশায় আবদ্ধ কোন সাধারন তুলির আঁচড় নয়, এটি জাতিস্মর বটে। জন্ম থেকে জন্মান্তরের সৃজনশীলতার অপূরণীয় চর্চা। তাদের সৃজনশীল চিত্তের উৎকর্ষে, আপন মননে, নীবির ভালবাসাতে এই শিল্পের আজ বিস্তর বিস্তার, যা আজ বিশ্ব দরবারে সমাদৃত।

তাই সুনাম গৌরবমণ্ডিত রাখতে হয়তো আলপনা গ্রামটির সঠিক মূল্যায়ন করা দরকার। বাণিজ্যিকরণ এলাকার লোকজনকে প্রভাবিত করছে। হ্যাঁ, অবশ্যই এর প্রয়োজন বাঞ্ছনীয়। কিন্তু ঐতিহ্যকে সঠিক মূল্যায়নের সাথে অর্থের ব্যাপারটা কোথাও গোলমেলে পটভূমিকার সৃষ্টি করে।

প্রাকৃতিক উপায়ে তৈরি করা রং এর পরিবর্তে যখন মোড়কে মোড়া রেড়িমেড রং ব্যবহার করতে এই ছোট্ট জনপদের সরল মানুষকে প্রভাবিত করা হয়, তখন মনে হয় অধরা ঐতিহ্যের প্রতি বুড়ো আঙ্গুল প্রদর্শন করা হচ্ছে…! যা কাম্য নয়…।

গ্রামীণ এই সব শৈল্পিক, সৃজনশীল ও অধরা ঐতিহ্যকে লালন-পালন করা আমাদের কর্তব্য। নব প্রজন্মের স্বার্থে, আমাদের সমৃদ্ধ ইতিহাস রক্ষার খাতিরে।