উত্তর জনপদের গ্রামীন মাটির বাড়ি

উত্তর জনপদের গ্রামীন মাটির বাড়ি

উত্তর জনপদের গ্রামীন মাটির বাড়ি

লেখকঃ ডঃ সাজিদ বিন দোজা বনি, ডীন ও বিভাগীয় প্রধান, স্থাপত্য বিভাগ, স্টেট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ

বাংলার স্থাপত্যে উঠানের ভূমিকা অপরিসীম। একটি মাটির বাড়ি র উঠান বৈজ্ঞানিক প্রজ্ঞামতে কাজ করে, সমসাময়িক স্থাপত্য চর্চাতে হাজার বছরের পরীক্ষিত উঠান অনুকরণীয় হওয়া উচিত। বিশ্ব স্থাপত্য ইতিহাসে গ্রামবাংলার আঙিনা বা উঠান নামক স্থানটি শীর্ষস্থানে অধিষ্ঠিত।

গ্রামবাংলার বসত হাজার বছর ধরে উঠানসমৃদ্ধ। শক্তিশালী একটি স্থান, যেখান থেকে বাংলার সরল-সহজ স্থাপত্যের সত্যতা প্রকাশ পায়। উঠানসমৃদ্ধ মাটির বাড়ি একটি টেকসই বা সহনশীল নির্মাণ। উঠান বা আঙিনা আমাদের পরিবেশ-পরিসর তৈরিতে এবং ঘের অনুভূতি দেয়। এক প্রকার নিজস্ব পরিমণ্ডল সৃষ্টি করে। আবহমান কাল ধরে গ্রামবাংলার বসতভিটার কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে উঠান। একটি আঙিনা বা উঠান স্থানীয় জলবায়ুর আঁধার (মাইক্রো ক্লাইমেট)। উঠান একটি ফাঁকা স্থান হওয়ার কারণে সার্বক্ষণিক বাতাস প্রবাহের সৃষ্টি হয়, গরম বাতাস ওপরে উঠে যায় আর ঠান্ডা বাতাস উঠানে প্রবাহিত হতে সাহায্য করে এবং বিভিন্ন ঘরে বাতাস প্রবেশ করে অন্যান্য দরজা অথবা জানালার মাধ্যমে আড়াআড়ি বায়ুপ্রবাহের (ক্রস-ভেন্টিলেশন) পথ তৈরি হয়। উঠান আবার আলোর উৎসও বটে, বারো মাস বাংলার আকাশে সূর্যের কিরণ আমরা পাই– কখনও তা প্রখর আবার কখনও বা নরম। আলোয় আলোয় ভরা উঠান শক্তির উৎস। উঠানসমৃদ্ধ বসতে দিনের সবসময় বাসিন্দারা বিভিন্ন কাজে জড়িত থাকেন; বিভিন্ন পরিবারের লোকজন দ্বারা ব্যস্ত থাকেন। বৃদ্ধ থেকে শুরু করে শিশু-কিশোর, তরুণ-তরুণী সবার কর্মক্ষেত্রের অনবদ্য স্থানটি আলো-বাতাসে ভরা, মৌসুমি বায়ুর প্রভাববান্ধব হয় মাটির বাড়ির উঠান। বিশেষ করে শীতকালে উষ্ণতা প্রদান আর গ্রীষ্মকালে আরামদায়ক তাপমাত্রার আধার অনন্য এসব উঠানসহ মাটির বাড়ি। পুরু দেয়াল থাকার জন্য তাপমাত্রা ধারণক্ষমতা অধিক থাকার কারণে এই পরিবেশের সৃষ্টি হয়।

মাটির বাড়ি

মাটির বাড়ি
লেখকের স্কেচে উত্তর জনপদের একটি গ্রামীন মাটির বাড়ি

বাংলার স্থাপত্য সমৃদ্ধ হয়েছে উঠানের কারনে।  আসা যাক উঠান ঘিরে অন্যান্য অবকাঠামোর অবস্থান বর্ণনায়। একতলা মাটির দালানের সমন্বয়ে এই অংশটিকে বলা হয় পরিবেশনার স্থান। এই অংশে বাড়ির মূল প্রবেশদ্বার এবং এর সঙ্গে একটি স্থান অবমুক্ত। বিশেষ এই স্থানের নাম ‘আকসালি’ বলে অভিহিত করা হয়। কুয়াতলা, হেঁসেল (রান্নাঘর), পুকুরের দিকে যাওয়ার দ্বার, প্রক্ষানালয়, স্নানঘর, গুদামঘর, গোয়ালঘর ইত্যাদির সমন্বয়ে কার্যকরী স্থানটি বিন্যাস হয়।

নির্দিষ্ট উচ্চতায় (৭-৯ ফুট) প্রথম তলটির প্রস্তুতি শুরু হয়। নির্মাণ উপকরণ হিসেবে তাল গাছের কাঠ, বাঁশ ও চাটাই গত্যন্তর উপায়ে একটির ওপর অন্যটি বসানো হয় শক্ত ও মজবুতভাবে। প্রথমে তালগাছের গুঁড়ি আড়াআড়ি দিক থেকে দুটি প্রধান দেয়ালের ওপর বসানো হয়, এরপর বাঁশকে ঘনভাবে সন্নিবেশ করে বিপরীত দিকনির্দেশনাতে স্থাপন করা হয়। রশি ও তারকাঁটার মাধ্যমে সংযোগগুলো শক্তভাবে বাধা হয়ে থাকে। প্রস্তুত হয়ে গেল শক্তিশালী কাঠামো, যার ওপরে চাটাই সমান করে বসানো হয়। পরবর্তী সময়ে মাটির আস্তরের মাধ্যমে প্রথমতলের কর্মক্রিয়া সম্পন্ন করা হয়। বুদ্ধিমত্তার পরিচয় পাওয়া যায় এর নকশায়; দুই ধরনের স্থানের অবস্থান দেখা যায় নকশা বিন্যাসে। দ্বিতল বড় ভবনটি উত্তর-দক্ষিণে উন্মুক্ত। আর এই অংশে নিচ তলাতে বসার ঘর, অতিথিশালা ও একটি শোয়ার ঘর রয়েছে। ঠিক ওপরে বাকি তিনটি শোয়ার ঘর নকশায় দেখা যায়। এসব ঘরে যাওয়ার জন্য নিচে একটি আধাখোলা বারান্দা আছে। এর ঠিক ওপরেরটি একটি ঝুলন্ত বারান্দার মাধ্যমে বাকি তিনটি ঘরে যাওয়া যায়। এই ঝুলন্ত বারান্দাটিকে ‘পীড়া সাজানি’ বলেন স্থানীয়রা। সুন্দর একটি কাঠের জাহাজি সিঁড়ি দিয়ে ওপরের তলায় ওঠা যায়।
আবহাওয়া সংবেদনশীল এই বসত এক সহনশীল স্থাপনা। বাংলার মাটির বসত নির্মাণের সঙ্গে পরিবেশ ও বাস্তুশাস্ত্রের পারস্পরিক সম্পর্ক বিদ্যমান। শৈল্পিক আঙ্গিকের অবতারণা ঘটে যখন মাটির বসতের দ্বিতল স্থাপনা বা দু-মহলার বিশদ মাটির আস্তর সমেত দেয়ালটি দৃশ্যমান হয়।

মাটির বসতবাড়ির গঠন মাটির ব্লক নির্মাণের মাধ্যমে হয়। বিশেষ প্রক্রিয়ায় মাটির প্রস্তুতি নেওয়া হয়। যেখানে ঘর বানানো হবে ঠিক তার আশপাশে নিচু এলাকায় মাটির মণ্ড, খড়কুটো, বিভিন্ন গাছের পচা পাতার পানি, তেঁতুলের পানি ইত্যাদি নিচু ওই জায়গাটিতে মিশিয়ে মাটি প্রস্তুত করা হয়। মাটি প্রস্তুতির সঙ্গে অনেক মানুষের সম্পৃক্ততা থাকে। পায়ের দ্বারা মাটির মণ্ড দলাই-মলাই কসরতের সঙ্গে করা হয়। একপর্যায়ে মাটির মণ্ড প্রস্তুত হয় এবং নির্মাণকাজের জন্য সাইটে ব্লক আকারে পাঠানো হয়। ১৫-২০ জন মানুষ এই যজ্ঞে জড়িত থাকেন। ঘরের নকশা অনুযায়ী ভিত্তি খনন করা হয়, গভীরতা থাকে সাধারণত ২-৩ ফুট। ওই একই গভীরতা থেকে প্রস্তুতকৃত মাটির মণ্ড দ্বারা প্রশস্ত ভিত্তির স্থাপনা শুরু হয়ে যায়। এ ধরনের মোটা মাটির ভিত্তিকে ‘কাথি’ বলে। মাটির দেয়াল বেশি উঁচু করে নির্মাণ করা যায় না। ২-৩ ফুট পর্যন্ত তোলার পর জমতে বা শুকাতে সময় দিতে হয়। পরের দিন আবার নির্মাণকাজ শুরু হয় মাটির ব্লক দ্বারা।

দেয়ালের গঠন নিচ থেকে ওপরে কমতে থাকে, মানে ভিতের অংশটি মোটা হয়। ওপরের অংশটি ধীরে ধীরে কমতে থাকে। কারণ ট্যাপারিং ওয়াল হওয়ার কারণে সহজে দেয়ালটি দাঁড়িয়ে থাকতে পারে, উলম্ব ভার শিথিল হয়ে যায়। ভিত্তির ওপরের অংশটি বিশেষভাবে আলাদা অংশ হয়, চোখে পড়ার মতো বর্ধিত মাটির গাঁথুনি, যেটি সরাসরি মাটি থেকে ওঠা শুরু করে, সাধারণত উচ্চতায় ৪ ফুটের মতো ওঠার পর প্রধান দেয়ালটির নির্মাণ প্রক্রিয়া শুরু হয়ে যায়। ‘কাথি’ আসলে ভিত্তির প্রধান অংশ। মাটির বাড়ির পরিপূর্ণ গঠন, ব্যালান্স এবং বলিষ্ঠতার মানদণ্ড। প্রধান দালানটি অনেক কিছুর সমন্বয়ে ঘটে। যেমন– দেয়াল, দরজা ও জানালার অবস্থান ও লিন্টেল প্রস্তুত করা ইত্যাদি। জানালা ও দরজায় খোলা জায়গা রাখার জন্য কাঠের তক্তা উপরিভাগে বসানো হয়, যেন ওপরের মাটির ভার যথাযথ প্রক্রিয়ায় বহন করতে পারে। কাঠের তক্তাটির প্রশস্ততা মাটির দেয়ালের প্রশস্ততার সম্পূরক। একইভাবে দরজা ও তার লিন্টেল স্থাপন করা হয়। সাধারণত দরজা-জানালা কাঠের এবং লোহার শিক জানালার নিরাপত্তার জন্য ব্যবহার করা হয়। দেয়ালের নিজস্ব গভীরতা থাকার জন্য জানালা ও দরজা উভয়েই ভেতর প্রান্তে দ্বিতল মাটির বসতে স্থাপন করাতে তা রোদ-বৃষ্টি থেকে রক্ষা পায়।

সাজিদ বিন-দোজার আরো আর্টিকেল।

#বাংলার_স্থাপত্য #মাটির_বাড়ি #স্থাপত্য #ডঃ_সাজিদ_বিন_দোজা_বনি

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *