মুঘল আমলের সেতুসমূহ

মুঘল আমলের সেতুসমূহ শেষ পর্ব-৪

মুঘল আমলের সেতুসমূহ

শেষ পর্ব-৪

শাহরিয়ার হাসান মৃধা রাতুল, প্রধান স্থপতি, মৃধা’জ ড্রয়িং হাউজ, নারায়ণগঞ্জ

মুঘল আমলের সেতুসমূহ –“ঐতিহাসিক: “সেতু” অথবা, “পুল” স্থাপনার হালখাতা। ফিরে দেখা সেকাল:বাস্তব পর্যবেক্ষণ ও যুগোপযোগী চিন্তা-ভাবনা।

মুঘল আমলের সেতুসমূহ পূর্বের তিনটি পর্বের পর চতুর্থ এবং শেষ পর্বের শুরু।

মুঘল আমলের সেতুসমূহ – প্রাচীন এই সেতু স্থাপনার দিনকাল : : বাস্তব পর্যবেক্ষণ ও দূরদর্শী মানসিকতা

মুঘল আমল ও তৎপরবর্তী সময়ে বহু দৃষ্টি-নন্দন সেতু এই বাংলায় গড়ে উঠেছে। প্রাচীন নথি, বই-পত্র ও ম্যাপ ঘাটঘাটি করলে এসব সেতু স্থাপনার অনেক রকম তথ্য মেলে। এসব নথি, বই-পত্র, ম্যাপ হল অকাট্য দলিল যাতে করে প্রাচীন এই স্থাপনার তথ্য মজুদ রয়েছে।
কোন-কোন সেতু স্থাপনার বাস্তব পর্যবেক্ষণ করা গেছে সেতুর সুনির্দিষ্ট পরিচয় পাওয়া গেছে বলে। আবার অনেক সেতুর সুনির্দিষ্ট পরিচয় পাওয়া যায় নি বলে সেতুর হদিস ও মেলে নি।
এক্ষেত্রে উল্টো ঘটনা ও ঘটেছে। দেখা যায় যে, সেতু আছে। সবাই চেনে, জানে অথচ তার কোন তথ্য-উপাত্ত নেই কোন দলিলে। সেক্ষেত্রে অনেকটা চোখের আড়ালেই পরে থেকে টিকে আছে এই স্থাপনা কিংবা ধ্বংস হয়েও যাচ্ছে।
সার্বিক বিষয় মাথায় রেখে যে অবস্থাগুলো চোখের সামনে দাঁড়িয়েছে তার মধ্যে –

• প্রত্ন স্থাপত্যের নেই কোন মূল্যবোধ : :

প্রতিটা সেতু স্থাপনা এক একটি প্রত্ন সম্পদ। সেতু স্থাপনা সমূহ এনলিস্টেড হউক বা না হউক বাস্তবে এদের অবস্থা করুন ও বেহাল অবস্থা। এদের প্রতি মানুষের দায় কম। যে যে রকম পারে এদের প্রতি আচরণ করে। কেউ বা ভেজা জাল শুকাতে ব্যবহার করে এই সেতু। পাগলা সেতুর সাথে আজকাল গরুও বেঁধে রাখে। আবার , কারো মন চাইলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে কয়েক টুকরো ইট নিয়ে গেলো। মানুষ নিজে মূল্যবোধ দিতে পারছে না এই প্রত্ন- স্থাপনা’র। প্রতিটা সেতু স্থাপনা এক একটি প্রত্ন সম্পদ। সেতু স্থাপনা সমূহ এনলিস্টেড হউক বা না হউক বাস্তবে এদের অবস্থা করুন ও বেহাল অবস্থা। দুই-একটা সেতু ছাড়া বাকিগুলো আজ কেন প্রত্নতক্তের এনলিস্টেড না ?

• প্রাচীন সেতুর স্থাপত্যশৈলীর বিনষ্টকরণ : :

এক একটা সেতু ছিল এক একটা আর্ট বা শিল্প। প্রতিটা সেতু স্থাপত্যগত দিক দিয়ে ছিল পরিপূর্ণ। মানুষের নিত্য দিনের ব্যবহার, যান চলাচল, আবহাওয়া ও জলবায়ুগত কারণ, সর্বপরি মানুষের অবহেলা প্রতিটা সেতু স্থাপনার স্থাপত্যশৈলীতে বিচ্যুতি ঘটিয়েছে। বেশিরভাগ সেতু স্থাপনা ভঙ্গুর ও জবুথবু অবস্থায় পরে আছে।সর্বাধিক নাজেহাল অবস্থায় পতিত হওয়া সেতুগুলো একেবারেই টিকে নেই। যেমন, খাঁজা আম্বার সেতু, টঙ্গি সেতু, তাঁতিবাজার সেতু ইত্যাদি। দেখা গেছে যে , এসব সেতু স্থাপনার কোন -কোনটির হয়তো স্প্যান ভেঙ্গে গিয়েছিলো, কোন-কোনটির একটিমাত্র খিলান বিশেষ অবশিষ্ট ছিল। আবার কাল-ক্রমে ক্ষয় হতে হতে ধ্বংসের দোরগোড়ায় এসে পৌঁছেছে পাগলা সেতু। মানুষ নিজে তার মূল্যবোধ দিতে না পেরে বুভার উপযোগী নতুন সেতু করার নিমিত্তে পুরানো সেতু ভেঙ্গেছে, তার উদাহরণ -ত্রিবেণী পুল, কেল্লার পুল ইত্যাদি। চাপাতলীর ইটের পুলে ও এমন কিছু হওয়ার সম্ভাবনা আসন্ন বলে মনে হচ্ছে। কে ফিরে তাকাবে এদের দিকে সময় দৃষ্টি দিয়ে ? মানুষ নিজেতো কেবল নিজের সুবিধাটুকো বুঝে। ঐতিহাসিক মূল্যবোধ কে দিতে জানে। প্রাকৃতিক বিপর্যয় যেমন,ভূমিকম্পে ও ক্ষতি সাধিত হয়েছে অনেক পুরোনো সেতুর। সেতু স্থাপনা স্থাপত্যশৈলীর দিক দিয়ে পরিপূর্ণ বটে কিন্তু ভাঙ্গাচূড়া কোন অংশ বাদ দিয়ে যে টিকে আছে তার নমুনা নেই। চাপাতলীর ইটের পুল এই সেতুর তো সম্পূর্ণ রেলিং, টরেন্ট ভেঙে পড়েছে। ভাঙা অংশ সংশ্লিষ্ট খালের জলে এখনো আছে। আবার, পানাম সেতু তে কোন কোন অংশে ফাটলের মাত্রা বেশি। পিঠাওয়ালীর পুল ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে শেষ দিনের অপেক্ষায়। অনেক সেতুর হদিস মেলে না। কেন ? হদিস মেলে না। ভেঙে ফেললে বা না টিকে থাকলে হদিস মিলবে কী করে ?

• প্রাচীন সেতুর গাঠনিক কাঠামো : :

স্থাপত্যশৈলীর দিক দিয়ে প্রাচীন এই স্থাপনা সামান্য পরিবর্তিত হলেও গাঠনিক কাঠামোতে বেশ ঘাটতি লক্ষ্য করা যায়। পলেস্তরা বা আস্তরণ উঠে গিয়ে ইটের প্রতিটা টুকরা দেখা যায় বা গুনতে পারা যায় এমন অবস্থা। একদিকে সেতু সমূহ বিবর্ণ রূপ ধারণ করেছে। আবার কোথাও কোথাও সেতু স্থাপনার মধ্যিভাগে ফাটল ধরেছে। ভেঙ্গে পড়েছে সেতুর উপরিভাগ বা মেঝের অংশবিশেষ। মূল যে গাঠনিক উপাদান : : ইট। সেই ইট নষ্ট হয়ে যাচ্ছে দিন হতে দিন।

• অরক্ষিত মুঘল আমলের সেতু স্থাপনা ও অলংকরণশৈলী : :

বেশিরভাগ সেতু’ই মুঘল আমলে তৈরী। যেমন : : পুলঘাটা সেতু, পানাম সেতু, পাগলা সেতু, চাপাতলীর ইটের পুল ইত্যাদি। মুঘল আমলের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য যে, এই সময়কালীন স্থাপনা সমূহ তে অনেক বেশি অলংকরণ এর মাত্রা দেখা যায়। প্রাচীন এই সেতু স্থাপনায় অলংকরণের অভাব প্রকট আকার ধারণ করেছে। মুঘল আমলের সেতু বাস্তবে মুঘল দূর্গ, কেল্লা বা মসজিদের মতো অনেক বেশি অলংকৃত হওয়ার কথা। বরঞ্চ, তা না হয়ে সামান্য কিছু প্যানেল ও মারলনের উপস্থিতি দেখা যায়। কালক্রমে বহুবার সংস্কার হয়েছে এসব সেতু স্থাপনা আর সেই সংস্কারের ফলেই বিলুপ্ত হয়েছে মুঘল অলংকরণশৈলী ও নান্দনিকতা। প্রকট।

• Archaeological Preservation : :

আর্কিওলজিক্যাল কনজারভেশন, প্রিজারভেশন ও প্রয়োজনীয় রেস্টোরেশন এর অভাবে এই স্থাপনা সমূহ আজ এতটা বিপন্ন। কোথাও কোথাও রেনোভেশন হয়েছে বটে কিন্তু আদি অলংকরণের চিহ্নমাত্র নেই। তাহলে এই রেনোভেশন এর অর্থ কী? যতটুকু ভেঙ্গে পরে যায়, অতটুকু ভাঙ্গা অংশ যত্ন করে রেখে দেয়াটাই কী সার্থকতা ? নাকি, ওই স্থানটির মেরামত করে পুনঃনির্মান জরুরি ?সেতু স্থাপনা ব্যবহার যোগ্য আবার অব্যবহারযোগ্য ।

• মনুষ্য সৃষ্ট কারণে সেতুর ক্ষতি : :

এসব সেতু স্থাপনা যতটা না প্রকৃতিগত ভাবে বিনষ্ট হচ্ছে তার চেয়ে বেশি নষ্ট হচ্ছে মনুষ্য সৃষ্ট কারণে। মানুষ এখনো এইসব সেতু ব্যবহার করে। আদলের সাথে ব্যবহার করার চাইতে এদের প্রতি মানুষের অনাচারের মাত্রাটাই বেশি।
সেতুতে খড় শুকানো, গোবরের গৈটা শুকানো, ভিজানো জাল শুকানো, কাপড় শুকানো ইত্যাদি সব রকমের কাজ ই হয়ে থাকে এইসব সেতুর উপরে। কোথাও কোথাও, এসব সেতু পুরোটাই পশু চারণ ভূমি কিংবা ময়লার ভাগাড়। ডাস্টবিনের ময়লা ফেলার বক্সের স্থান ও পায় সেতুর উপরে। দুরন্ত, লাফাঙ্গা ছেলেপুলেদের সেতুর উপর থেকে ক্রমান্বয়ে লাফ দিয়ে সাঁতার কাটা যেমন রেলিং গুলোর বিনষ্ট করেছে তেমনি সেতুর ক্ষতি সাধন করেছে। সেতুর যেসব স্থানে ফাটল ধরেছে। সেসব স্থানে প্রয়োজনী ও মেরামতের অভাবে সবুজ ঘাসের, মস, ক্যাপসুল ও শৈবালের জন্ম নিয়েছে। সেতুর দেয়ালের যায় কালি দিয়ে লিখাটা কি অনাচার এর মধ্যে পরে না ?প্রাচীন এই সেতুর পরিপূর্ণ স্থাপত্য শৈলী প্রকট অভাব ধারণ করে আছে। পরিপূর্ণ উপাদান নিয়ে টিকে আছে এমন স্থাপনা বিরল।

• প্রয়োজনীয় ও সুনির্দিষ্ট ডকুমেন্টেশন এর অভাব : :

প্রতিটা ঐতিহ্যবাহী স্থাপনার ডকুমেন্টেশন জরুরি। দুই-একটা সেতু ছাড়া বাকিগুলো কেউই তেমন চেনে না, জানে না। এর পেছনে কারণ কী ? সুর্নিদিষ্ট তথ্য,উপাত্ত, নির্দেশনাবলীর অভাব। এখনো নিজেদের দেশের এই সম্পদের প্রতি আমাদের কোন দায় নেই। তাছাড়া লোকদের ঐতিহ্যপ্রীতি ও কম। আবেগ দিয়ে নয় বিবেগ দিয়ে ভাবার বিষয় এসব। এখনো এমন সব ঐতিহাসিক স্থাপনা আছে যাদের সুর্নিদিষ্ট ডকুমেন্টেশন নেই। ডকুমেন্টেশন নেই বলে এখনো বিখ্যাত সব পেইন্টিং বা ছবি দেখে এদের চিহ্নিত করা হয় , উপলব্ধি করা হয়।

মুঘল আমলের সেতুসমূহ – শেষ কথা : :

মুঘল আমলের সেতুসমূহ

প্রাচীন এই সেতু স্থাপনার সবচেয়ে করুন অবস্থা গুলো স্বচক্ষে দেখা যায়।  সবাই কেবল দেখে। কেউ কেউ আফসোস করে।  কেউ কেউ একজন আরেকজনকে উদ্দেশ্য করে একে অন্যের টনক নড়ানোর চেষ্টা করে। আবার, কেউ কেউ অতি রাগ দেখায়।  হট্টগোল করে। হৈ-চৈ করে একটা দুন্ধুভার কান্ড করে ফেলে।  আবার কারো কারো জীবন কাটে এইসব স্থাপনা ঘুরে ঘুরে আর ছবি তুলে। নিজেদের তোলা ছবি জনসমুক্ষে প্রকাশ করে। লিখালিখি ও হয়, পত্র-পত্রিকায়। রিসার্চ ও বের হয়।  রিসার্চের মাধ্যমে দেশি ও আন্তর্জাতিক মাধ্যমে একটা সাড়া ফেলা যায়।  স্থাপনাগুলোর প্রতি মানুষ কে আকৃষ্ট করা যায়।  গণমাধ্যম গুলোতে হয়তো একটা টনক নড়ে। কিন্তু, সত্যিকার অর্থে এই স্থাপনাগুলো নিয়ে কি কোন কাজ হচ্ছে ? এরা কী বেঁচে থাকতে পারছে ? যেখানে পাগলা সেতুর ধংসাবশেষ এর মত খণ্ডিত অংশ তাও আবার মুঘল আমলের স্থাপনা মাটিতে লুটিয়ে মরে। সব শেষ হয়ে গেলে কেউ আবার আফসোস করে মরে? অধিদপ্তরে গিয়ে রাগ দেখায়। ফেইসবুক, টুইটার এর মতো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে এসে নিজের হাতে তোলা ছবি পোস্ট করে দুঃখ প্রকাশ করে।  আর কবে এদের নিয়ে লোকেদের টনক নড়বে ? এখনো সব স্থাপনা অধিদপ্তরের এনলিস্টের বাইরে।  শেষ হয়ে গেলে পরে বা অন্যের মালিকানাধীন থাকা কোন স্থাপনাকে আমার ঐতিহ্য বলে হৈ-চৈ করার কোন মানেই হয় না। কে জানে, এইসব স্থাপনা গুলো শেষ পর্যন্ত আদৌ কী বেঁচে থাকবে ? নাকি যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলবার এদের কোন অধিকার নেই।  শেষ হয়ে গেলে পরে সবাই বলবে।  “ছিল এক সময় বটে” কিংবা, ইংরেজিতে “Once Upon A Time”.

                           ……….সমাপ্ত……….

বিশেষ কৃতজ্ঞতায়  : : প্রতিটা সেতু সার্ভে ও ডকুমেন্টেশন এ সহায়তাকারী : : আফনান প্রান্ত,ছাত্র,সাউথ ইস্ট বিশ্ব বিদ্যালয়, ঢাকা।
বাড়িউড়া সেতুর ছবি প্রদান করে : : জনাব ইবরাহীম,এডমিন: :ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ইতিহাস ও ঐতিহ্য।

পূর্ববর্তী পর্ব

#mughal_bridges #মুঘল_আমলের_সেতুসমূহ #shahriar_mridha_ratul #পানাম_নগর #মিরকাদিমের_সেতু #হাতিরপুল_ব্রাহ্মণবাড়িয়া

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *