গ্রামীণ জনপদের ঘর বাড়ি_ঘর-৯
গ্রামীণ জনপদের ঘর বাড়ি_ঘর-৯
[লেখকঃ স্থপতি মাহফুজুল হক জগলুল, প্রধান স্থপতি, ইন্টারডেক সিস্টেমস, ঢাকা]
আবাসন, যাপিত জীবন ও পলি প্লাবিত ঘোলা জলস্রোতের জলজ নেটওয়ার্ক :
গ্রামীণ জনপদের ঘর বাড়ি_ঘর-৯ I জোয়ার ভাটা কেন্দ্রিক দক্ষিনাঞ্চলে উঠান ডুবে গিয়ে প্রায়শই ঘরের মধ্যে জোগার সময় বা জলোচ্ছ্বাসের সময় পানি ঢুকে যেতে চায়। আমি আগের লেখায় বলেছি নদী থেকে বহুদূরের পুকুরেও এখানে জোয়ার ভাটা হয়। ছোট ছেলে মেয়েরা যখন উঠানে পুতুল পুতুল খেলতে খেলতে দা দিয়ে কুপিয়ে ১২/১৪” গভীর ছোট্ট পুকুর কাটে একটু পরেই দেখা যায় মাটির ভিতর থেকে জুলজুল করে পানি এসে বালক বালিকাদের সেই খেলার ছোট্ট পুকুর পানিতে টলটল করছে। এই হচ্ছে দক্ষিনাঞ্চলে জল ও মৃত্তিকার অবিচ্ছেদ্য রহস্যময় হাইড্রোলজি। জল ও জীবন এখানে একাকার এবং পরস্পর পরিপূরক । নদী বা বড় খাল থেকে ছোট ছোট খাল বা ব্যাড়ের ( সরু লম্বা খালের মতো জলাশয় যা ছোট খাল বা নদীর সাথে কখনো যুক্ত কখনো বিযুক্ত ) মাধ্যমে একটা যোগাযোগের জলজ নেটওয়ার্ক আপনি আপনিই যেন অরগ্যানিক ভাবে গড়ে উঠেছে। খাল বা ব্যাড়ের উপর ১/২ টা সুপারি গাছের কান্ড বা বাশ ফেলে নিচের জলধারাকে মোটেও ব্যাহত না করে এ অঞ্চলের শিশু থেকে আশি বছরের বৃদ্ধ পর্যন্ত তরতর করে অনায়াসেই পার হয়ে যতে পারে। রাস্তার যেমন মেইন রোড, সেকেন্ডারি রোড, টারশিয়ারি রোড থাকে এখানেও মূলত চলাচল ও পন্য পরিবহন যেহেতু পানিকে কেন্দ্র করে তাই নদী, বড় খাল, ছোট খাল, ব্যাড় এমন করে বড় থেকে ছোট জলপথের নেটওয়ার্ক আস্তে আস্তে গড়ে উঠেছে। নিজস্ব ড্রাইভওয়ের মতো নিজস্ব একটা জলের রাস্তা বা খাড়ির মতো কেটে ঘরের একদম কাছে এনে রাখা হয়, নিজের গাড়ি আমরা যেমন বাড়ির সামনের ড্রাইভওয়েতে পার্ক করে রাখি এখানেও তেমনি নিজস্ব পানির খাড়িতে নিজের নৌকা রেখে এক পা দিয়েই ঘরে ওঠার ব্যবস্থা করা হয় নদী বা খাল সংলগ্ন এলাকায়।
মোট কথা জলের স্রোতধারা আর বসতবাড়ির আঙিনা একটা প্রানবন্ত সুচারু নেটওয়ার্কের মাধ্যমে নিবিড়ভাবে সংযুক্ত। যাপিত জীবন ও জীবীকা, মানবিক সম্পর্ক ও সংগ্রাম, যাতায়াত, পন্য পরিবহন, খেলাধুলা, বিনোদন বা শিল্প ও ভাব চর্চা সব কিছুই এখানে নিগুঢ় ভাবে নদ নদী,খাল বিল বেস্টিত জলস্রোত নির্ভর…..এ জল কোন আবদ্ধ জল নয়, এ জল জোয়ার ভাটার নিরন্তর পরিবর্তনশীল পলিবাহী প্লাবনকারী প্রানবন্ত ঘোলা জল।
এই জনপদ সমুহের জল, জীবনের ও পরিবেশের ওতোপ্রোতো সম্পর্কের নিবিড়তা ও পারস্পরিক নির্ভরতা অধ্যয়ন না করেই গত কয়েক দশক ধরে উন্নয়নের নামে যে সব অপরিকল্পিত বেড়িবাঁধ, সুইসগেট, রাস্তা ইত্যাদি নির্মাণ করা হচ্ছে তা শত শত বছরের এই সাবলীল সহজাত জোয়ার ভাটার জলনির্ভর পরিবেশবান্ধব জীবন ব্যবস্থাকে মারাত্মক ভাবে আক্রান্ত করছে, এর পরিনতি কিছুতেই ভালো হবে না।
এখানে পোস্ট করা ছবিগুলোর দিকে পর্যবেক্ষণ করলেই জিনিসটা পরিস্কার হবে বলে আমার ধারনা। প্রথমদিকের বেশ কিছু ছবি আজ (২০.০৮.২০) তুলে এলাকা থেকে আমাকে পাঠিয়েছে, গত কয়েক দিন সমুদ্র খুব উত্তাল তাই ‘ পুবাল বাতাসে ‘ পানির চাপ খুব বেশি। অন্য সব ছবি অনেক আগে আমার নিজের তোলা।
কেউ আবার ছবির এই পানিকে বন্যার পানি মনে করবেন না……. এই পানি হলো উঁচু জোয়ারের পানি যা কখনো কখনো ১ দিন বা ২ দিনের মধ্যে নেমে যাবে। এই জনপদে পানি ওঠার বা নেমে যাবার পথের কোন কমতি নাই।
আমার বন্ধু স্থপতি বিকাশ ছোট করে লিখতে বলেছে তাই এই পর্বটা ছোট করে লিখলাম তবে শত শত বছর ধরে মানুষের বাসস্থান ও জীবনযাত্রার সাথে সতত পরিবর্তনশীল জলস্রোতের জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশবান্ধব এই সুনিবিড় জল ও মৃত্তিকার নেটওয়ার্ক কিন্তু এই জনপদ সমুহের এক অনন্য সাধারণ চরিত্র ও লাগসই জীবনধারার অবিচ্ছেদ্য অংগ যা মোটেই কিন্তু ছোট কোন বিষয় নয়।
পূর্বের পর্বের জন্য ক্লিক করুন
One thought on “গ্রামীণ জনপদের ঘর বাড়ি_ঘর-৯”
Comments are closed.