গ্রামীণ জনপদের ঘর

গ্রামীণ জনপদের ঘর বাড়ি_ঘর-৬ (১ম পর্ব)

গ্রামীণ জনপদের ঘর বাড়ি_ঘর-৬ (১ম পর্ব)

[লেখকঃ স্থপতি মাহফুজুল হক জগলুল, প্রধান স্থপতি, ইন্টারডেক সিস্টেমস, ঢাকা]

একটা মোটামুটি টিপিক্যাল গ্রামীণ জনপদের ঘর । গ্রামের নিম্ন মধ্যম ও মধ্যম স্তরের গৃহস্থের
ঘরের কাঠামো ও নির্মান কৌশল
পিরোজপুর

আমি আমার লেখাগুললোর মাধ্যমে গ্রামীন প্রান্তিক মানুষের যুগ যুগান্তরের আবাসন সমস্যার চরম মানবেতর অবস্থার মানবিক দিকগুলো ফোকাসে আনতে চেয়েছিলাম কিন্তু অনেকে আমার সাথে যোগাযোগ করে আমার লেখার একাডেমিক ফোকাসটি গুরুত্বের সাথে ডকুমেন্টেশন করার উপর উপদেশ দিয়েছে। আমার ধারনা গ্রামীণ বাড়িঘরের উপর প্রচুর একাডেমি কাজ এদেশে হয়েছে, বিদেশের নানা বিষ্ববিদ্যালয়ে আরো বেশি হয়েছে, তাই আমার এই অভিজ্ঞতার কাছাকাছি ঘরবাড়ির উপর একাডেমিক ডকুমেন্টেশন এদেশে আলরেডি আমার চেয়ে অনেক ডিটেইলড ও সমৃদ্ধভাবে বহুজনের গবেষণা কাজেই অনেক বেশি জ্ঞানগর্ভ বিশ্লেষণের মাধ্যমে উঠে এসেছে। আমি মনে করি যে কোন গবেষণার পেছনে সৎ মানবিক আবেগ না থাকলে তা প্রকৃতপক্ষে মানবজীবনে কোন সুফল বয়ে আনে না। মানব ইতিহাসের সব সার্থক সামাজিক আন্দোলন বা বিপ্লবে পিছনে ছিল সৎ ও ন্যায্য তীব্র মানবিক আবেগ। সৎ আগেবহীন গবেষণা বৈষয়িক সমৃদ্ধি আনতে পারে কিন্ত শেষমেশ ইতিহাসের দিক পরিবর্তনে বা অবহেলিত জনগনের ভাগ্য পরিবর্তনে তা তেমন কাজে আসে না। আমি একবার একটা বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম বলতে চাচ্ছিনা) লাইব্রেরিতে সানান্য ঘাটাঘাটি করেছিলাম, সেখানে দেখেছি শত শত থিসিস পেপার যার ৯০% ই ঢাকার বস্তি ও রিকশা কেন্দ্রীক যাতায়ত ব্যবস্থা নিয়ে………সে প্রায় ২০/২৫ বছর আগের ঘটনা,এতোদিনে হয়তো ঢাকার বস্তির উপর রিসার্চ পেপারের সংখ্যা আরো কয়েকগুন হয়েছে কিন্তু গত ২৫ বছরে কি ঢাকার বাস্তিবাসীদের আবাসন মানের বিন্দুমাত্র কোন পরবর্তন হয়েছে?

এতো বিশাল জনগোষ্ঠির আবাসনের এই চরম মানবেতর অবস্থার লাগসই উন্নতির জন্য প্রয়োজন সংশ্লিষ্ট সকল পেশাজীবি, সুশীল সমাজ, রাজনীতি ও প্রসাশনকে সাথে নিয়ে সুদৃঢ় কমিটমেন্টসহ একটা প্রবল ‘জাতীয় সামাজিক গ্রামীন আবাসন আন্দোলন’ গড়ে তোলা এবং এর নেতৃত্বে অবশ্যই থাকতে হবে সৎ মানবিক আবেগ সম্পন্ন স্থপতিদের।

তারপরও, আমার অন্যন্ত প্রিয় আদনান মোর্শেদ ও প্রিয় রম্য রহিম চৌধুরীর সহ আরো অনেকের সাজেশন অনুযায়ী ডকুমেণ্টেশনের যেহেতু মূল্যবান সামাজিক, নৃতাত্ত্বিক ও ঐতিহাসিক গুরুত্ব আছে তাই আমি এ পর্বে আমাদের অঞ্চলের একটা মোটামুটি টিপিক্যাল গ্রামের নিম্ন মধ্যম ও মধ্যম স্তরের গৃহস্থের ঘরের কাঠামো ও নির্মান কৌশল ও আনুসাঙ্গিক বিষয়াবলি নিয়ে কিছু আলোচনা করছি যা পরবর্তী পর্বের লেখাগুলো বুঝতে হয়তো সাহায্য করবে।

এবার একটা মোটামুমি টিপিক্যাল গ্রামীণ জনপদের ঘর  বা গ্রামের নিম্নমধ্যম স্তরের গৃহস্থের ঘরে কথা বলিঃ

দক্ষিনাঞ্চলের ঘরের সাইজের একক হলো ‘বন্দো’। সাধারনত সামনের ও পিছনের অংশ বাদে ঘরের মধ্য অংশের বড় স্পেসের মাপই ঘরের মাপ হিসাবে ধরা হয়।ঘরের মধ্যের এই প্রধান স্পেসকে স্থানীয় ভাষায় বলে ‘শাল ঘর’। শাল ঘরের দৈর্ঘ+প্রস্থ= বন্দো। যেমন ধরা যাক যদি শাল ঘরের মাপ হয় ১১ হাত X ৮ হাত ,তার মানে এই ঘরটির মাপ হলো ১৯ বন্দো (১১+৮ = ১৯)। তবে ঘর শুধু এতোটুকুই নয়, এর সাথে সামনে থাকবে সাধারনত ৫হাত X ১১ হাত একটা ফরমাল বৈঠকখানা (স্থানীয় ভাষায় বলে সামনের হাইতনা), পিছনেও থাকবে ৫ হাত X ১১ হাত একটা ‘হাইতনা’ যেটা সাধারনত ডাইনিং স্পেস ও মহিলা মহল। পিছনের ‘হাইতনা’ দিয়ে মহিলারা যাতায়ত করে আর এটা ঘরের বাইরের রান্না ঘরের যোগাযোগ রক্ষা করে। অর্থাৎ সম্পুর্ন ঘরের মাপ ১১ X (৫+৮+৫) ,অর্থাৎ ১১ হাত X ১৮ হাত প্লিন্থ স্পেসের (স্থানীয় ভাষায় বলে পোতা) এই ঘরটাকে বলা হবে ১৯ বন্দো ঘর। এক হাত সমান ১৮” ধরা হলে ১৯ বন্দো একটি ঘরের টোটাল প্লিন্থ এরিয়া হবে ৪৪৫.৫০ বর্গফুট। সবচেয়ে ছোট ঘর হলো ১৭ বন্দো, আর একটু বড় হলে ১৯ বন্দো তারপর ২১ বন্দো……এভাবে বিত্ত,বৈভব আর পৈতৃক জমির মাপের উপর নির্ভর করে ঘরের সাইজ যা ২৯ বন্দো থেকেও আরো বড় হতে পারে পারে। বড় বনেদী ঘরগুলো সাধারনত দোতলা হয়ে থাকে,কিছু ঘর আছে তিনতলা।

উচ্চ জোয়ার বা জলচ্ছাসের কথা চিন্তা করে মাটির প্লিন্থ সাধারনত ৩’ থেকে ৩.৫’ পর্যন্ত উঁচু হতে পারে,এই প্লিন্থ কে স্থানীয় ভাষায় বলে ‘পোতা’ । ৩’ উঁচু প্লিন্থ হলে একটি ১৯ বন্দো ঘরের প্লিন্থের জন্য প্রায় ১৩৫০ ঘনফুট মাটি দরকার। এখন কথা হলো এতো মাটি এখন কোথায় মিলবে। আগে বাড়ি বাড়ি গভীর নলকুপ ছিলোনা তাই ধণী দরিদ্র নির্বিশেষে প্রতিটা বাড়ির পিছনেই থাকতো একক বা মজগুনি / এজমালি পুকুর।এইসব পুকুর রান্নাবান্নার কাজে ও বিশেষ করে মহিলাদের গোসলের জন্য ব্যবহৃত হতো, এছাড়াও ঐ পুকুরের মাটি দিয়েই বাড়ির উঁচু প্লিন্থ বানানো হতো। এখন যৌথ পরিবারিক কাঠামো ভেঙ্গে যাওয়ায় মাথাপিছু জমি কমে গেছে তাই পুকুরের জায়গা জোগাড় করা কঠিন আর নলকুপের কারনে পুকুরের প্রয়োজনিয়তা অনেক কমে গেছে তাই মাটি কিনে আনতে হয় অন্য ধানী জমি থেকে। আসেপাশের ধানী জমি থেকে এক ‘চট’ (১২” গভীর) মাটি কেটে নিলে ১৩৫০ ঘনফুট মাটির জন্য প্রায় ১ কাঠা জমি দরকার। অনেকের কাছে হিসাবটা ভুল মনে হতে পারে কেননা ৭২০ বর্গফুটে এক কাঠা হলেও আমাদের দিক্ষিনাঞ্চলের অনেক এলাকায় ৬৬ ডেসিমেলে এক বিঘা হয় যেখানে ঢাকায় ৩৩ ডেসিমেলে এক বিঘা, অর্থাৎ ঢাকার ২ কাঠায় আমাদের ১ কাঠা। এই ১ কাঠা (১৪৪০ বর্গফুট) জমির মাটি ১ চট কেটে নিলে পরবর্তী ৩ বছর তার জমিতে ফসল হবেনা তাই তাকে লাভসহ অন্তত ২৫০০ থেকে ৪০০০ হাজার টাকা না দিলে সে মাটি বেচবে না। এ ছাড়া মাটি কাটা আর মাটি বাড়ি পর্যন্ত বয়ে নিয়ে আসার জন্য মাটি কাটার মজুরদের দিতে হবে ৬০০০ থেকে ১০০০০ হাজার টাকা।

আমাদের এলাকা যেহেতু জোয়ার ভাটা প্রবন তাই জোয়ারের পলিতে ৩ বছরের মধ্যে ওই মাটি কাটা নিচু জমি পলি দ্বারা পরিপূর্ন হয়ে আবার আগের লেভেলে চলে আসবে। গংগা,ব্রহ্মপুত্র, মেঘনা নদী সমুহ হাজার হাজার মাইল ঘুরে হিমালয় থেকে বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত এই বিশাল অঞ্চলের জন্য যে বিশাল পরিমান পলি নিয়ে এসে প্রতি বছর আমাদের নতুন করে প্রান দেয় তা যে সৃস্টিকর্তার কত বড় উপহার তা হিসাব করে শেষ করা যাবে না…… আসলে প্রতি বছরের এ বিপুল পরিমান মিহিন চকচকে উর্বর পলিই আমাদের প্রধান লাইফ লাইন। আলহামদুলিল্লাহ।

সত্যি কথা বলতে গেলে এই মূল্যবান পলি বাহিত নিরন্তর জলধারাই কখনো আড়াল থেকে কখনো সরাসরি নিয়ন্ত্রন করে এই জনপদের স্থাপত্যসহ আমাদের সকল শৈল্পিক সৃস্টিশীলতা ও বৈষয়িক কর্মকান্ড।

ঘরের নির্মান কৌশলে ফিরে আসি……সাধারনত এখন চালে ও পার্টিশনে করোগেটেড আইরন সিট (সহজ ভাষায় বলে টিন) কাঠের ফ্রেমে বসিয়ে ঘর বানানো হয়। যারা অবস্থাসম্পন্ন তারা বাইরের ও ভিতরের পার্টিশনের জন্য কাঠ ব্যবহার করে। কাঠের পার্টিশনের ঘরগুলো গরমের দিনে ঠান্ডা থাকে শীতের দিনে অপেক্ষাকৃত উষ্ণ ও আরামদ্যক থাকে।তবে চালে এখন সবাই ই করোগেটেট সিট ব্যবহার করে। সম্পুর্ন টিনের ঘরগুলো গরমের দিনে সাক্ষাৎ ‘হাবিয়া দোজখ’, তারপরো তারা সবাই টিন ব্যবহার করে কেননা টিনের ঘর চোর ডাকাতের কথা বিবেচনা করলে অনেক নিরাপদ, কমদামী কাঠের তুলনায় দীর্ঘস্থায়ী ( কেননা বেশি দামি কাঠ ব্যবহার করা নিন্ম বা মধ্যবিত্ত গৃহস্থের পক্ষে সম্ভব না) এবং পোকামাকড় আর সাপের অনুপ্রবেশ থেকেও অনেক নিরাপদ, এছাড়াও টিনের ঘরের সামজিক সন্মান বেড়ার ঘরের চেয়ে বেশি। এখানে স্থপতিদের ও প্রকৌশলীদের গবেষনার বিশাল স্কোপ ও চ্যালেঞ্জ আছে ……গ্রামীন মানুষের জন্য এমন একটা ম্যাটেরিয়াল বের করা যা একইসাথে উপরোল্লেখিত তাদের সব চাহিদা পুরন করবে আবার একই সাথে তা হবে সাস্টেইনেবল, আরামদায়ক ও সাশ্রয়ী । এক রডের যে রেডিমেড সরু কঙ্ক্রিট খুটি অনেকদিন ধরে হাট বাজারে পাওয়া যায় তা দিয়ে অনেকেই দোকানপাঠ তৈরি করে কিন্তু তা দিয়ে বসতঘর সাধারণত কেউ বানায় না তার প্রাধান কারন কঙ্ক্রিটের খুটির সাথে কাঠের ফ্রেম শক্তভাবে ফিক্স করা করা যায় না, যেটা কাঠের খুটির সাথে কাঠের ফ্রেম শক্তভাবে ফিক্স করা যায়। ফ্রেম শক্ত না হলে তা ঘড় বাতাস সহনীয় হয় না। কাঠের ফ্রেমের জোড়ালো স্ট্রাকচারাল বন্ধনই আসলে কাঠের ঘরের কাঠামোর প্রাধান শক্তি।
(চলবে…………)

পরের পর্বের লিঙ্ক https://tinyurl.com/y3ugtyna

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *