ঢাকায় যখন ল্যুই আই কান
ঢাকায় যখন ল্যুই আই কান
[Author: স্থপতি মুহাইমিন শাহরিয়ার, ফাউন্ডার, আর্ক-বাংলা]
কান পেতে কানের কথা জানতে কসরত করে যখন অফলাইন কিতাব-প্রতিবেদন সার্ফিং করছিলাম তখন নজরে আসে ঢাকায় বিশ্ব স্থপতি ল্যুই আই কান এর প্রথম সফরের কিছু তথ্য। ঢাকায় ল্যুই আই কানের আগমন শুধু একটা সফরই ছিল না বরং এর সাথে অন্তর্নিহিত ছিল একজন গুরু স্থপতির অমর স্থাপত্য রচনার সূচনালগ্নের কথকতা। তাই এই বিষয়টা নজরগোচর হবার পর ভাবলাম কানের স্থাপত্য দর্শণ বা সংসদ ভবনের নান্দনিকতা নিয়ে বিস্তর লেখা রয়েছে। কিন্তু বিশ্ব স্থপতির নিজ একটি কালজয়ী সৃষ্টির সুতিকাগারে অমর স্থাপত্যের জন্মপূর্ব বিচরন ও তাঁর পর্যবেক্ষণ নিয়েও আমাদের জানার প্রয়োজন আছে। তাঁর এই কর্মকান্ড ছিল নতুন ধরনের স্থাপত্যবোধের একটি বিকাশকাল। “সেকেন্ড ক্যাপিটাল অফ ইস্ট পাকিস্তান” প্রকল্পে কান কিভাবে নিযুক্ত হয়েছিলেন; তার কাজের প্রি-বিড মিটিং; তাঁর পারিশ্রমিকের নেগোসিয়েশন বা তাঁর ব্যবসায়িক লেনদেন কেমন ছিল। অথবা কিভাবে তিনি তাঁর আইডিয়াগুলো প্রেজেন্টেশন করেছিলেন; কেমনই বা ছিল তাঁর ডিজাইন পূর্ববর্তী প্রকল্পের সাইট মূল্যায়ন এবং সাইট ভিজিটে তিনি এই অঞ্চলকে কোন দৃষ্টিকোন থেকে দেখেছিলেন ও তাঁর ডিজাইনে এর কোন প্রভাব পড়েছিল কিনা; আবার কান এর অফিস তৎকালীন সরকারকে কোন প্রক্রিয়ায় তাদের প্রয়োজনীয় সম্মানীর যৌক্তিকতা তুলে ধরেছিলেন, অন্যদিকে কান তাঁর আইডিয়াকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য কতটুকু প্রসব বেদনাই বা সহ্য করেছিলেন সেসব সম্পর্কে কিঞ্চিৎ ধারনা দেবার জন্যই এই লেখার অবতারণা। ঢাকায় যখন ল্যুই কান
ল্যুই আই কান কে দায়িত্ব প্রদান
গণতন্ত্র এবং স্থাপত্যের মধ্যে সম্পর্ক বহুমুখী, যা রাজনৈতিক আদর্শ এবং সামাজিক মূল্যবোধ কীভাবে নির্মিত পরিবেশকে রূপ দিতে পারে তা প্রতিফলিত করে। সংসদ ভবন, আদালত, সিটি হল ইত্যাদির স্থাপনার মাধ্যমে স্থাপত্যে গণতন্ত্রের মূলনীতি প্রতিফলিত হয়। গণতান্ত্রীক রাষ্ট্র বা সমাজের স্থাপতিক বহিঃপ্রকাশের একটি মাধ্যম হচ্ছে সংসদ ভবন। নিজেকে আধুনিক এবং গণতন্ত্র বান্ধব প্রমানের কপট উচ্চাভিলাশে স্বৈরাচারী প্রেসিডেন্ট স্বঘোষিত ফিল্ড মার্শাল আইউব খান ১৯৫৮ থেকে ১৯৬৯ এর শাসনামলে পাকিস্তানকে আধুনিকীকরণের চেষ্টা করেছিল। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য নতুন সরকারি ভবন নির্মাণও ছিল। সেই মহা পরিকল্পনার অংশ হিসেবে পাকিস্তানের রাজধানীকে করাচী থেকে স্থানান্তরিত করে ইসলামাবাদে নতুন রাজধানী স্থাপন এবং পূর্ব পাকিস্তানে রাজধানী ঢাকার উপকন্ঠে “সেকেন্ড ক্যাপিটাল অফ ইস্ট পাকিস্তান” প্রকল্পের অধীনে মর্যাদাবান ভবন নির্মাণের আয়োজন করা হয়েছিল। পল রুডলফ, স্টানলি টাইগারম্যান, ডক্সিয়াডিস এবং আরো পশ্চিমা স্থপতিরা এই অঞ্চলে সেই সময় বিভিন্ন প্রকল্পে কাজ করছিলেন। আইউব খান ইসলামাবাদের নকশা প্রস্তুত করতে স্থপতি ও পরিকল্পনাবিদ কনস্টান্টিনোস অ্যাপোস্টলো ডক্সিয়াডিস কে নিযুক্ত করেছিলেন। পূর্ব পাকিস্তানের জন্যও তাকে নিয়োগের ইচ্ছে থাকলেও আইয়ুব সরকার নানান নাটকীয়তার পর এবং শ্রদ্ধাভাজন স্থপতি মাজহারুল ইসলামের মধ্যস্থতায় ১৯৬২ সালের শুরুর দিকে ল্যুই আই কানকে দিয়ে ঢাকায় তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের দ্বিতীয় রাজধানী নকশা করানোর জন্য সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। ১৯০১ সালের ২০ ফেব্রুয়ারীতে ইউরোপের এস্তোনিইয়ার কুরাসার শহরে এক দরিদ্র ইহুদি পরিবারে ল্যুই ইসাডর কান এর জন্ম হয়। ভাগ্য পরিবর্তনের আসায় তাঁর অভিভাবক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফিলাডেলফিয়ায় শহরে চলে আসলে তিনিও সেখানে চলে আসেন এবং সারা জীবন সেখানেই কাটান। কান তাঁর জীবদ্দশায় স্থপতি হিসেবে সুদীর্ঘ কর্মজীবন অতিবাহিত করলেও তিনি তাঁর নিজস্ব স্থাপত্য শৈলী খুঁজে পান কর্মজীবনের প্রায় শেষের দশকে এবং খ্যাতিমান হওয়া শুরু করেন। পরিসর বিন্যাসে তাঁর অন্যতম অবদান ছিল সেবক এবং সেবিত পরিসরের শ্রেনীভেদ প্রবর্তনের দর্শন।
ল্যুই আই কান এর ঢাকা আগমন
দায়িত্ব পাওয়ার পর, কান ১৯৬২ সালের শুরুর দিকে প্রথম ঢাকায় একটি সংক্ষিপ্ত সফর করেন জমি পরিদর্শণ এবং সরকারে প্রয়োজনীয় ইচ্ছে গুলো জানার জন্য। তিনি বিভিন্ন সরকারি কর্মকর্তার সাথে, স্থানীয় স্থপতি এবং পরিকল্পনাকারীদের সাথে একাধিক আলোচনা করেন। প্রকল্পের কি কি ফাংশন থাকবে তা সঠিকভাবে কেউ বিশ্লেষণ দিতে না পারায় কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে কানকে ভবনের কার্যকারীতা এবং এর প্রয়োজনীয় ফাংসনগুলোর উপর গবেষণা করতে এবং এর ভিত্তিতে একটি উপস্থাপনা তৈরি করতে বলা হয় যাতে কর্তৃপক্ষ কানের ডিজাইন কন্সেপ্ট এবং উদ্দেশ্যগুলি বুঝতে পারেন। যদি তার উপস্থাপনা গ্রহণযোগ্য হয়, তবে উভয়পক্ষের মাঝে একটি চূড়ান্ত চুক্তি স্বাক্ষরিত হবে মর্মে আলোচনা করে এই দফায় কান সফর শেষ করেন।
এই সফর শেষে লুই আই কান তাঁর দেশে ফিরে গিয়ে সাইটের পরিকল্পনা এবং কমপ্লেক্সের নকশা আঁকায় মনোনিবেশ করেন। এ সময় তিনি খুব গর্বিত এবং উচ্ছ্বসিত ছিলেন, যা একদমই স্বাভাবিক ছিল। কতবারই বা একজন স্থপতি বিদেশের একটি রাজধানী নকশা করার সুযোগ পায়? এর প্রায় বছর খানেক পর ১৯৬৩ সালের মার্চের শুরুতে তিনি উপস্থাপনাটি প্রস্তুত সম্পন্ন করেন। এবং পুনরায় ঢাকায় ভ্রমণের জন্য প্রস্তুতি নিতে থাকেন।
কান তার সহকর্মী স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ার অগাস্ট ই কোমেন্ড্যান্ট এবং কানের অন্যতম সহকারী কার্লেস ভ্যালহোনরাটকে ঢাকায় সফরসঙ্গী হিসেবে যুক্ত করেন, যাতে তারা সাইট এবং স্থানীয় অবস্থা পর্যালোচনা এবং স্থানীয় কর্তৃপক্ষের সাথে আলোচনায় তাকে পরামর্শ দিতে পারেন। কানের দল ৬ মার্চ ১৯৬৩ তারিখে নিউইয়র্ক থেকে যাত্রা শুরু করে প্যারিস-রোম-করাচি হয়ে ৮ই মার্চ ১৯৬৩ ঢাকায় পৌঁছান। সরকারি প্রতিনিধি দল তাদের টীমকে বিমানবন্দর থেকে অভ্যর্থণা জানিয়ে আন্তর্জাতিক হোটেলে পৌছে দেন।
অর্থমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাৎ
পরের দিন সকালে তাদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয় অর্থমন্ত্রী এবং অন্যান্য উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তাদের সাথে। অর্থমন্ত্রী, যিনি অক্সফোর্ড বা লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক ছিলেন, খুবই বন্ধুত্বপূর্ণ এবং বুদ্ধিমান ব্যক্তি ছিলেন। কিছু সাধারণ সৌজন্যমূলক কথাবার্তার পর কান পরিকল্পনাগুলি দেখান, বিন্যাস এবং তার উদ্দেশ্যগুলি ব্যাখ্যা করেন। কান অর্থমন্ত্রীসহ অন্যান্যদেরকে তার প্রস্তুতকৃত বড় ভলিউমের এবং চৌকশভাবে বানানো খসড়া নকশা এবং মাস্টার প্ল্যান তার কন্সেপ্টসহ উপস্থাপন করেন। উপস্থিত প্রত্যেকেই তা আগ্রহ নিয়ে দেখেন এবং তার প্রস্তাবিত খসড়া নকশায় সন্তুষ্ট হন। কানের পরিবেশনাটি প্রচুর পরিমাণ কাজের সমন্বয়ে তৈরী করা হয়েছিল। অর্থমন্ত্রী কানকে ধন্যবাদ জানান এবং প্রস্তাব দেন তাঁরা যেন সাইট এবং স্থানীয় পরিস্থিতির সাথে নিজেকে পরিচিত করার জন্য পরবর্তী সময় ব্যয় করেন। অর্থমন্ত্রী তাদের জন্য বাহন এবং গাইড হিসেবে একজন প্রকৌশলী নিযুক্ত করেন যাতে তাঁরা সাইট এবং পার্শ্ববর্তী এলাকা সাবলীলভাবে ভ্রমণ করতে পারেন এবং কোনো ভুল জায়গায় গিয়ে সমস্যায় না পড়েন।
সাইট ভিজিট এবং পারিপার্শ্বিকতা পর্যালোচনা
প্রথমে কান তাঁর সফরসঙ্গীদের নিয়ে “সেকেন্ড ক্যাপিটাল অফ ইস্ট পাকিস্তান” এর প্রস্তাবিত ২১৫ একর আয়তনের স্থানটি পরিদর্শন করেন, যা শহরের কেন্দ্র থেকে তেমন একটা দূরে ছিল না এবং সাইটটি ছিল তৎকালীন বিমানবন্দরের কাছাকাছি। প্রকল্প এলাকাটি সমতল ছিল। তিনি অনুধাবন করেন এখানকার ল্যান্ডস্কেপ একটি সাধারন পলিমাটি সমৃধ্ব বদ্বীপ এলাকার সমতল ক্ষেত্র। এর বেশির ভাগ অঞ্চল জুড়েই ছিল একটি কৃষি বিদ্যালয়ের অধ্যয়ন এবং গবেষণার জন্য ব্যবহৃত কৃষি ভূমি। পারিপার্শিকতা বিবেচনায় এখানে নতুন স্থাপনা নির্মাণের জন্য ভূ-প্রকৃতিগতভাবে কোন বাধা ছিল না। তারা সেদিনের মতো প্রস্তাবিত সাইট পরিদর্শন শেষে সীদ্ধান্ত নেন যে এই অঞ্চল সম্পর্কে অধিকতর ধারনা পেতে পরবর্তী কয়েকটি দিন ঢাকার আশেপাশের অঞ্চল পরিদর্শণ করবেন।
লুই আই কান ও তাঁর দল আশেপাশের অঞ্চল পরিদর্শনকালে দেখতে পান পারিপার্শ্বিক এলাকার ল্যান্ডস্কেপ প্রধানত অসংখ্য নদীবেষ্টিত পলল নিম্নভূমি। এখানকার বাড়ীগুলো মাটির স্তূপের উপর নির্মিত হতো এবং পার্শ্ববর্তী এলাকার চেয়ে কয়েক ফুট উঁচু ছিল। বাড়ি উচু করার প্রয়োজনীয় মাটি সংগ্রহের জন্য খননকৃত গর্তটি মাছের পুকুর হিসাবে ব্যবহার করা হত। বর্ষাকালে হিমালয় থেকে আসা ঢলে নদীগুলো উপচে পড়তো এবং নিম্নাঞ্চল প্লাবিত করতো। পানির উচ্চতা যখন বেশি থাকতো তখন উচু ঢিবির ওপর থাকা বাড়ীগুলোর একটি থেকে আরেকটিতে গমানাগমনের জন্য নৌকাই ছিল একমাত্র বাহন। এর পর যখন পানির স্তর কমে যেত তখন বাড়ির পাশের পুকরগুলো মাছে পরিপূর্ণ হয়ে ঊঠতো। তাই কৃষকদের সারা বছর মাছের অভাব হতো না। বসতবাড়ির পার্শ্ববর্তী উঁচু স্থানে কৃষকদের দ্বারা উৎপাদিত ইটের স্তূপ ছিল, যা তারা স্থানীয়ভাবে তৈরি মাটির চুলায় পুড়িয়ে অত্যন্ত আদিম পদ্ধতিতে এসব ইট উৎপাদন করতো। এর পর কান ও তার সঙ্গীরা নদীর তীরাঞ্চল পরিদর্শণ করেন। যেখানে তারা দেখেন যে নদীর তলদেশ থেকে পরিষ্কার বালি সংগ্রহ করা হচ্ছে। একজন যুবক ডুব দিয়ে পানির নিচে ঝুড়িতে বালি ভর্তি করত এবং তারপর দড়ি দিয়ে তা তীরে টেনে আনা হত। কাজটা খুবই সহজ ছিল।
প্রায় সকালেই কানের সহযোগীরা আশেপাশের নির্মাণ সাইটগুলো পরিদর্শন করতেন, স্থানীয় উপকরণ ও কাজের পদ্ধতিগুলো পর্যালোচনা করার জন্য। যথেষ্ঠ গরমের কারনে দিনে বাইরে থাকা কষ্টসাধ্য ছিল, তাই তারা স্থানীয় স্থপতি ও প্রকৌশলীদের সাথে কথা বলতেন। প্রচলিত সিমেন্টের মান খুবই খারাপ ছিল, যা প্রধানত চীন থেকে আমদানি করা হত। পাটের দড়ি দিয়ে বাঁধা বাঁশের খুঁটি ছিল মাচা এবং স্ক্যাফোল্ডিং কে সাপোর্ট দেবার জন্য। ফর্মওয়ার্কের জন্য নিম্নমানের তক্তা ব্যবহার করা হতো। দেয়ালের উপাদান ছিল ইট, যা প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যেত। রডও চীন থেকে আমদানি করা হত। কংক্রিট মেশানো, রড বাঁকানো এবং উপকরণগুলি হাতে হাতে বহন করা হত। কাজের মান বেশ খারাপ ছিল। বড় বিদেশি কোম্পানির নির্মাণ সাইটগুলোতে কংক্রিট মিক্সার এবং ছোট ক্রেনও পাওয়া যেত। কানের সঙ্গীরা স্থানীয় ইঞ্জিনিয়ারদের সাথে বেশ কয়েকবার সাক্ষাৎ করেছিলেন, তাদের মধ্যে কয়েকজন ছিলেন দক্ষ এবং যুক্তরাজ্য ও এমনকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পড়াশোনা করা। তাদের মধ্য থেকে একজনকে লুই আই কানের অফিসের স্থানীয় প্রতিনিধি হিসেবে নিয়োগের সিদ্ধান্ত কান গ্রহণ করেন।
কানের খসড়া নকশা এবং কর্তৃপক্ষের মন্তব্য
কান তাঁর সহযোগীদের নিয়ে পরিদর্শন কাজ চালানোর ফাঁকে পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ ড্রইং ও স্কেচগুলি পরীক্ষা করার জন্য সময় পেয়েছিল। তারা কানের কাজ এবং তার ধারণাগুলি দেখে মুগ্ধ হয়েছিল। তবে তাদের প্রধান উদ্বেগ ছিল ইসলামিক বৈশিষ্ট্য, বিশেষ করে মসজিদ স্থাপত্য, তার অবস্থান এবং দিকনির্দেশনা সম্পর্কিত।
বাংলাদেশে বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায় রয়েছে—মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ইত্যাদি। তাদের মধ্যে গভীর মতপার্থক্য বিদ্যমান। মসজিদ কেবল মুসলমানদের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ। তখন প্রশ্ন উঠল—মসজিদ কেন প্রয়োজন? তারা নিজেদের মধ্যে এ নিয়ে বিতর্ক করছিল, কিন্তু কোনো সমঝোতা বা সমাধান পাওয়া যাচ্ছিল না।
এই অবস্থায় সেদিনের মতো কান হোটেলে ফিরে তাদের নিজেদের মধ্যে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করলেন। যদিও বেশিরভাগ সরকারি কর্মকর্তা মুসলমান ছিলেন, তবুও তারা অন্য ধর্মগুলিকে উপেক্ষা করার অধিকার রাখতেন না। অবশেষে, তারা সিদ্ধান্তে পৌঁছান যে সমস্ত ধর্মের জন্য একটি ধ্যানের স্থান (meditation place) তৈরি করাই একমাত্র সমাধান হতে পারে, যেখানে এমনকি একজন নাস্তিকও প্রবেশ করতে পারবে। এটি কাবার দিকে মুখ করা যেতে পারে, তবে ঐতিহ্যবাহী মসজিদের মতো দেখতে হওয়া উচিত নয়।
পরবর্তী বৈঠকে আবারও মসজিদের প্রসঙ্গ উঠল। তখন কান সবার বিতর্ক থামিয়ে বললেন যে, সকলকে একজন গণিতবিদের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া উচিত, যিনি এই সমস্যার একটি সমাধান বের করেছেন। এরপর তিনি জ্যামিতিক যুক্তি সহকারে তাঁর সমাধান ব্যাখ্যা করলেন। সবাই একমত হলো, এবং এইভাবে মসজিদের সমস্যা সমাধান হয়ে গেল।
চূড়ান্ত চুক্তি এবং ডিজাইন ফিসের ন্যায্যতা
পরবর্তী আলোচনার বিষয় ছিল চুক্তি, অর্থ, সময়সূচি এবং অর্থপ্রদানের ব্যবস্থা। কান প্রকল্পের মোট নির্মাণ ব্যয়ের ৭ শতাংশ ফি দাবি করেন। কিন্তু অর্থমন্ত্রী ৫ শতাংশ প্রস্তাব দেন এবং বলেন যে, অনেক নামকরা বিদেশি স্থপতি ৫ শতাংশ ফি-তে কাজ করতে রাজি ছিলেন, তাহলে কান-এর জন্য ৭ শতাংশ ন্যায্যতা কীভাবে প্রতিষ্ঠা করা যাবে? যদি তিনি এভাবে বেশি পরিমাণ অনুমোদন করেন, তাহলে সংসদ তাকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দেবে!
এটি একটি বড় দোটানা ছিল। সমস্যা সমাধানের জন্য কানের সহচর ইঞ্জিনিয়ার অগাস্ট আলোচনায় অংশ নিলেন এবং বল্লেন, তারা অন্য স্থপতিদের তুলনায় একেবারেই ভিন্ন ধরনের সেবা প্রদান করবেন। তাদের সেবায় অন্য স্থপতিদের সাথে পার্থক্য থাকবে। অর্থমন্ত্রী জানতে চাইলেন, এই পার্থক্যগুলো কী?
তিনি ব্যাখ্যা করলেন:
• প্রথমত, আমরা স্থানীয় স্থপতি ও প্রকৌশলীদের ব্যবহার করব এবং তাদের প্রশিক্ষণ দেব, শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত—নকশা পর্ব থেকে নির্মাণ পর্ব পর্যন্ত।
• দ্বিতীয়ত, আমরা আপনার দেশীয় অবস্থা, উপকরণ এবং শ্রমশক্তি সম্পর্কে গবেষণা করেছি। আমরা এমন নির্মাণ পদ্ধতি ও সরঞ্জাম ব্যবহার করব, যা আমাদের কাজ শেষ হওয়ার পরও আপনার দেশ ব্যবহার করতে পারবে।
• আমাদের প্রথম পদক্ষেপ হবে একটি প্রিকাস্টিং এবং প্রি-স্ট্রেসিং প্ল্যান্ট স্থাপন করা, যা নির্মাণ কাঠামোর গুরুত্বপূর্ণ উপাদান তৈরি করবে। এতে আপনার প্রকৌশলী ও কর্মীদের প্রশিক্ষিত করা হবে।এই প্ল্যান্টের সাথে থাকবে একটি ব্যাচিং প্ল্যান্ট এবং রেডি-মিক্স কংক্রিট ট্রাক, যা ঢাকার যেকোনো জায়গায় কংক্রিট সরবরাহ করতে পারবে।
• যদি আপনারা চান, আমরা একটি সিমেন্ট কারখানাও ডিজাইন ও নির্মাণ করতে পারি, যা আপনার দেশের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।
• আমরা আপনাদের জন্য কিছু ক্রেন এবং খননযন্ত্রও সরবরাহ করতে পারি, যা নদীর তলদেশ থেকে বালু সংগ্রহে সাহায্য করবে।
• আমরা নিশ্চয়তা দিতে পারি যে, যখন দ্বিতীয় রাজধানীর ভবনসমূহ নির্মিত হবে, তখন পূর্ব পাকিস্তান হবে নির্মাণ ক্ষেত্রে এই অঞ্চলের সবচেয়ে উন্নত দেশ।
এই ব্যাখ্যা কান এবং উপস্থিত কর্মকর্তারা গভীর মনোযোগ দিয়ে শুনলেন। এরপর অর্থমন্ত্রী বললেন,-“তাহলে আপনার এই কাজটি শিক্ষামূলকও হবে?”
কান উত্তর দিলেন, “হ্যাঁ, অবশ্যই,” এবং অত্যন্ত সুন্দরভাবে অগাস্টের ব্যাখ্যাগুলোর সমর্থন দিলেন।
অর্থমন্ত্রী বললেন,-“ঠিক আছে, যদি আমরা এই প্রকল্পটিকে আপনাদের ব্যাখ্যার মতো বিবেচনা করি, তাহলে ৭ শতাংশ ফি ন্যায়সঙ্গত করা সম্ভব। আমাদের দেশ সবচেয়ে বেশি যে জিনিসের প্রয়োজন তা হলো এই ধরনের শিক্ষা ও অভিজ্ঞতা।”
সকল সরকারি কর্মকর্তারা, বিশেষ করে প্রকৌশলী ও স্থপতিরা এতে উচ্ছ্বসিত হলেন। এরপর অর্থমন্ত্রী বললেন যে, তিনি চাইছেন এই নকশাগুলো ও স্কেচগুলো তাদের কনফারেন্স হলে প্রদর্শন করা হোক, যেখানে প্রধানমন্ত্রী এবং সংসদ সদস্যরা একত্রিত হবেন। তিনি কান এবং তাঁর সাথীদেরকেও সেখানে উপস্থিত থাকার জন্য অনুরোধ করলেন, যেন কেউ প্রশ্ন করলে তারা তাঁর ব্যাখ্যা দিতে পারেন।
প্রধানমন্ত্রী এবং সাংসদদের অভিমত
কনফারেন্স হলের সভায় কানের আঁকা নকশা, স্কেচ, এবং মডেলের ছবি দিয়ে সাজানো প্রদর্শনীটি সত্যিই সকলের ওপর ভালো প্রভাব ফেলেছিল, এবং সর্বপোরি কান খুবই আনন্দিত হলেন। এরপর ল্যুই আই কান এবং তাঁর সহযোগীদের সাথে প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ সদস্যদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হলো এবং তাদেরকে প্রথম সারির আসনে বসার আমন্ত্রণ জানানো হলো। অর্থমন্ত্রী প্রধানমন্ত্রীকে সার্বিক পরিস্থিতি এবং কানের সঙ্গে চুক্তির বিষয়টি ব্যাখ্যা করলেন। সবকিছু খুব মসৃণভাবেই চলছিল।
হঠাৎ সবাইকে চমকে দিয়ে এক সংসদ সদস্য উঠে দাঁড়িয়ে বললেন,
“মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, সবকিছুই খুব ভালো দেখাচ্ছে, বিশেষ করে শিক্ষামূলক অংশটি, যা আমাদের খুবই প্রয়োজন। তবে আমার শুধু একটি প্রশ্ন—আমরা মুসলমান, আরবদের আত্মীয়, তাহলে এই প্রকল্পের জন্য একজন ইহুদি স্থপতিকে কেন নিয়োগ দেওয়া হলো?”
কানের মুখ লাল হয়ে গেল, এবং সভাসদ ভীত হলেন যে কান হয়তো উঠে চলে যাবেন। কিন্তু তিনি তা করলেন না।
প্রধানমন্ত্রী উত্তর দিলেন, “মহোদয়, এটি এক কথায় বলা যায় যে, “কান” সেরা! তবে হয়তো আপনার প্রশ্নের উত্তরের জন্য একটি গল্প বলা ভালো হবে: আয়ারল্যান্ডের একটি স্কুলে একটি বৃত্তি প্রতিযোগিতা ছিল এবং পরীক্ষার প্রশ্নগুলির একটি ছিল ‘ইতিহাসের সবচেয়ে ধর্মপ্রাণ ব্যক্তি কে?’ সকল ছাত্র ভুল উত্তর দিয়েছিল, শুধু একজন ইহুদি ছেলেই সঠিক উত্তর দিয়েছিল—সেন্ট প্যাট্রিক। বিচারকরা অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তুমি তো ইহুদি, তোমার কাছে কি মুসা সবচেয়ে ধর্মপ্রাণ ব্যক্তি নন? তবে কেন সেন্ট প্যাট্রিক?’ ইহুদি ছেলেটি উত্তর দিল, ‘আমি জানি, কিন্তু ব্যবসা তো ব্যবসাই!’ উপস্থিত সবাই হাসতে শুরু করল এবং কানের ইহুদি সমস্যার সমাধান হল।
প্রধানমন্ত্রী তার গল্প শেষ করে বললেন, “আমরা আমাদের দ্বিতীয় রাজধানী নকশা করার জন্য একজন স্থপতি খুঁজছিলাম, যিনি নিখুঁত কাজ করতে পারেন। আমরা তাঁকে পেয়েছি, এবং তিনিই লুই আই কান।”
এরপর পুরো সভাকক্ষ করতালিতে মুখরিত হয়ে উঠল এবং কানের সম্মানে এক অভূতপূর্ব সম্মান প্রদর্শন করা হলো।
আইউব খানের অনুরোধ
সব আলোচনা সফলভাবে শেষ হওয়ার পর পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি, আইয়ুব খান, লুই আই কানের সম্মানে তার বাসভবনে একটি ছোট পার্টির আয়োজন করলেন। তিনি ঢাকায় দ্বিতীয় রাজধানী গড়ে তুলতে তাঁর দেশকে সাহায্য করার জন্য কানকে ধন্যবাদ জানালেন। তিনি মতামত দিলেন নকশা গুলি চমৎকার। এমনকি উল্লসিত হয়ে তিনি কানকে তার প্রাসাদ এবং পশ্চিম পাকিস্তানের নতুন রাজধানীর জন্য আরো কিছু নকশা করার অনুরোধও করলেন। তারপর রাষ্ট্রপতি তাদের বললেন যে পূর্ব পাকিস্তানে অস্থিরতা চলছে এবং তিনি চান নির্বাচনের আগে সেকেন্ড ক্যাপিটাল কমপ্লেক্সের নির্মাণ কাজ শুরু করা হোক। কান রাষ্ট্রপতির প্রস্তাবে খুবই উদ্দীপিত হলেন এবং প্রতিশ্রুতি দিলেন যে তিনি জুলাইয়ের শুরুতে ঢাকায় ফিরে আসবেন চূড়ান্ত বিন্যাস এবং পরিকল্পনা নিয়ে, যা নির্মাণ শুরু করতে সাহায্য করবে। নৈশভোজের পরেরদিন কান তাঁর সহযোগীদের নিয়ে কলকাতা, দিল্লী, আগ্রা, করাচী ভ্রমন শেষে ফিলাডেলফিয়ায় ফিরে যান।
দোদুল্যমানতার দোলাচলে কান
দেশে ফিরে কান ঢাকার কাজের দিকে তার মনোযোগ নিবদ্ধ করলেন। অগাস্ট, কিস্ট এবং হুড সম্মিলিতভাবে নির্মাণের ধারাবাহিকতা এবং নির্মাণ সরঞ্জামের প্রয়োজনীয়তা যাচাই করতে শুরু করলেন। কান ঢাকায় তাঁর উপস্থাপিত প্রাথমিক পরিকল্পনাগুলোতে সন্তুষ্ট ছিলেন না। তাই তিনি সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছিলেন এবং বার বার ডিজাইন সংশোধন করছিলেন। পরিবর্তন এবং সংশোধনগুলো পর্যায়ক্রমে ঘটছিল, কিন্তু জুলাই পর্যন্ত বেশি সময় বাকি ছিল না। তিনি খুবই নার্ভাস ছিলেন এবং প্রায়ই স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ার অগাস্ট ই কোমেন্ড্যান্টের সাথে আলোচনা এবং পরামর্শের চালিয়ে যাচ্ছিলেন।
জুন মাসের শেষ সপ্তাহে, কান অগাস্টকে ফোন করলেন। তিনি প্রায় হিস্টিরিক অবস্থায় ছিলেন, অভিযোগ করলেন যে তার সঠিক সাহায্য নেই, তিনি প্রতিশ্রুত পরিকল্পনাগুলো তৈরি করতে পারেননি, এবং তিনি পরিকল্পনা অনুযায়ী ঢাকায় যাচ্ছেন না। কারন তাঁর যথার্থ প্রস্তুতি ছিল না। এর মূল কারন ছিল কান তখনও চূড়ান্ত স্থাপতিক নকশায় স্থির হতে পারছিলেন না। তাই এর কনস্ট্রাকশন ড্রইং প্রস্তুত করা এগনো যাচ্ছিল না। যেটা দিয়ে পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ নির্মাণ কাজ শুরু করতে পারে। অগাস্ট কানকে বলেন কান যদি সহযোহিতা করেন তবে এক সপ্তাহের মধ্যে ড্রইংগুলো প্রস্তুত করা সম্ভব। কিন্তু কান একমত হলেন না এবং সরাসরি বললেন, তিনি প্রস্তুত হবেন না এবং তার ভ্রমণ অন্তত এক মাস পিছিয়ে দেবেন। কিন্তু স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ার অগাস্ট ই কোমেন্ড্যান্ট রেগে গিয়ে বললেন কানকে সময়মতো যেতে হবে, কারণ তাঁরা মার্চ মাসে রাষ্ট্রপতিকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন এবং কান সহযোগিতা করলে প্রয়োজনীয় বাকী কাজগুলো সময়মতো শেষ করা সম্ভব। এর প্রেক্ষিতে কান দ্রুত ডিজাইন ডিসিশনগুলো নিতে পুরো সপ্তাহজুড়ে তাঁরা টীম ওয়ার্ক করলেন এবং প্রয়োজনীয় কাজের জন্য যে ড্রইং দরকার ছিল, তার থেকেও বেশি সম্পন্ন করলেন। সহকর্মীদের চাপে এবং সুষ্ঠ টীম ওয়ার্কের কল্যাণে কান ১৯৬৩ সালের জুলাই মাসের যথা সময়েই পুনরায় ঢাকায় ভ্রমণ করে কর্তৃপক্ষের কাছে তাঁর প্রেজেন্টেশণ উপস্থাপন করে পুনরায় ফিলাডেলফিয়ায় ফিরে আসেন।
দেশে ফিরে আসার পর কানের সাথে অগাস্টের দেখা হলে কান তাকে জানান যে, তিনি অর্থমন্ত্রীর সাথে মিটিং করলেও তিনি ড্রইং গুলো জমা দেননি। কারন হিসেবে তিনি কর্তৃপক্ষের কাছে অগাস্টের ওপর দায় চাপান যে অগাস্ট তাঁর অংশের কাজ সময়মতো শেষ করতে পারেননি। বস্তুত কান তখনও তাঁর কাংক্ষিত এবং পছন্দসই লক্ষ্যে পৌছতে না পারায় এই অযুহাত তৈরী করেছিলেন। এতে বোঝা যায় যে, কান তাঁর দর্শনের ব্যাপারে আপোষহীন থাকার কারনে জুলাইতে ঢাকায় আসলেও নির্মান কাজ শুরুর জন্য কোন ড্রইং জমা দেননি। কান আরো সময় নেবার কারনে সংসদ ভবনের নির্মান কাজ বিলম্বিত হয়ে পরবর্তীতে ১৯৬৪ সালের অক্টোবর মাসে আরম্ভ হয়।
১৯৬৮ বা ১৯৬৯ সালের শেষের দিকে কান জাতীয় সংসদ ভবনের ছাদের নকশা নিয়ে পুনরায় সিদ্ধান্ত হীনতায় পড়েন। এবং অগাস্টের সাথে আলোচনা করে এর সমাধান করেন। এর কিছুদিন পরেই দুই পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয় এবং নির্মাণ কাজ বন্ধ হয়ে যায়। যুদ্ধের কিছু সময় পরে কান বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে বার্তা পান যে তারা প্রকল্পটি শেষ করতে চায় এবং খুব শিগগিরই তিনি ঢাকায় যাবার সিদ্ধান্ত নেন।
ল্যুই আই কান এর কথকতা
কিছু সেরা আধুনিক ভবনের নকশা করা সত্ত্বেও, কান প্রায়শই আর্থিকভাবে সমস্যায় পড়তেন। তিনি ক্লায়েন্টদের কাছ থেকে তুলনামূলকভাবে কম পারিশ্রমিক হাঁকতেন, কিন্তু বিশদ গবেষণা এবং নকশা সংশোধনে অতিরিক্ত সময় ব্যয় করতেন। কখনও কখনও এই অতিরিক্ত খরচ তিনি নিজেই বহন করতেন। এর ফলে তার ব্যবসা আর্থিকভাবে অস্থিতিশীল হয়ে পড়েছিল এবং সাফল্য সত্ত্বেও তিনি প্রায়শই ঋণগ্রস্ত থাকতেন।
জাতীয় সংসদ ভবন প্রকল্পটিতেও বছরের পর বছর ধরে নকশা সংশোধন এবং দীর্ঘায়িত নির্মাণ সময়ের কারণে, প্রকল্পের ব্যয় উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছিল। তবে, ব্যয় অতিরিক্ত হওয়া, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা এবং কান-এর ব্যক্তিগত আর্থিক সমস্যার কারণে কান তার কাজের সাথে মিল রেখে ফি পাননি। তবে তিনি কাজ চালিয়ে যান এবং ঢাকার কাজকে এগিয়ে নিতে সল্ক ইন্সটিটিউট থেকে প্রাপ্ত অর্থ দিয়ে অর্থায়ন করেন। পরবর্তীতে তিনি ঢাকার কাজে সম্পূর্ণ পারিশ্রমিক পেয়েছিলেন কিনা তা অনিশ্চিত।
১৯৭৪ এ কানের মৃত্যুর পর এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর ১৯৮২ সালে জাতীয় সংসদ ভবন কমপ্লেক্সের নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হয়। যদিও কানের মাস্টারপ্ল্যান অনুযায়ী সমস্ত ভবন নির্মাণ সম্ভব হয়নি। তথাপিও এটি গণতন্ত্র এবং স্থাপত্যের উজ্জ্বলতার প্রতীক হিসেবে রয়ে গেছে।
বস্তুত, শুধু সৃজনশীলতা নয় বরং স্থপতির ত্যাগ, কনসেপ্টের প্রতি তাঁর একাত্মতা, সংগ্রাম এবং কাজের প্রতি আবেগ ছাড়া কোন স্থাপত্য কর্মই তার পূর্ণাঙ্গ রূপ পায় না। আর্থিক চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও, কানের জাতীয় সংসদ ভবন বিংশ শতাব্দীর অন্যতম সেরা স্থাপত্য সাফল্য হিসেবে রয়ে গেছে, যা বাংলাদেশে গণতন্ত্র এবং পরিচয়ের প্রতীক।
——–
তথ্যসূত্রঃ কানের ১৮ বছরের সঙ্গী প্রখ্যাত স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ার অগাস্ট ই কোমেন্ড্যান্টের স্মৃতিচারণ।