মুঘল আমলের সেতুসমূহ পর্ব-১
মুঘল আমলের সেতুসমূহ পর্ব-১
শাহরিয়ার হাসান মৃধা রাতুল, প্রধান স্থপতি, মৃধা’জ ড্রয়িং হাউজ, নারায়ণগঞ্জ
মুঘল আমলের সেতুসমূহ –“ঐতিহাসিক: “সেতু” অথবা, “পুল” স্থাপনার হালখাতা। ফিরে দেখা সেকাল:বাস্তব পর্যবেক্ষণ ও যুগোপযোগী চিন্তা-ভাবনা।
মুঘল আমলের সেতুসমূহ : নিগূঢ় ভাব-বচন ::
মুসলিম বিজয়ের পরে বাঙলা ১২০০ শতক থেকে ১৫২৬ শতক পর্যন্ত ছিল বাঙলা সুলতানাত যুগ। এই অন্তর্বর্তীকালীন সময়ে বহু নান্দনিক ও দৃষ্টিনন্দন স্থাপনা এই বঙ্গে গড়ে উঠে। মুসলমানেরা নগরায়ণের প্রক্রিয়া অনুসরণ ও অনুকরণ করে এই বঙ্গে নানাবিধ স্থাপনা গড়ে তোলে। এসব স্থাপনার মধ্যে রয়েছে -মসজিদ, সমাধি স্থাপনা, খানকাহ, দরবার শরীফ, দরগাহ, ঈদ গাহ, ত্বোরণ দ্বার, প্রাচীর, ঘাট ইত্যাদি।
আবার ১৫২৬ শতক থেকে ১৮৫৮ শতক পর্যন্ত ছিল এই বাঙলার মুঘল সালতানাত যুগ। মুঘলদের হাত ধরেও বহুমুখী স্থাপনা এই বঙ্গে গড়ে উঠে। দেখা যায় যে, সুলতানি আমলের অধিকাংশ স্থাপনার বর্ধিতকরণ, অলংকরণ ও পরিবর্তন এই সময়ে হয়ে থাকে। মুঘলরা এই বঙ্গে দূর্গ বা কেল্লা, অতিউচ্চ ঘেরা প্রাচীর, অন্ধকূপ, মসজিদ, ইমারত, সেতু ও ঘাট নির্মাণে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছে।
সেতু বিনির্মানের পেছনে মুঘলদের হাতে খনন করা পরিখা, দিঘী বা খালের কথা উল্ল্যেখ করতে হয়। ভারতের দিল্লিতে অবস্থিত পুরানা কিল্লার পার্শ্বে খনন করা পরিখা যেমন প্রকৃষ্ট উদাহরণ তেমনি বাংলাদেশের খিজিরপুর (বর্তমান হাজীগঞ্জ কেল্লা) ও সুবর্ণকান্দি (সোনাকান্দা কেল্লা) সংলগ্ন স্থানে কেল্লার পুল খাল ও ত্রিবেণী খাল খনন করা হয়েছিল ।প্রতি’টা স্মৃতি বিজড়িত খাল বা পরিখার সাথে জড়িয়ে রয়েছে এক একটা সেতুর গল্প। আমরা যাকে “পুল” নামেও ডাকি। কেল্লার পুল খালে অবস্থিত “কেল্লার পুল” ও ত্রিবেণী খালে অবস্থিত “ত্রিবেণী পুল”।
এইসব “সেতু” বা,”পুল” আজ অবধি টিকে রয়েছে বহু চরাই-উৎরাই পার হয়ে। কালের করালগ্রাসে নিমজ্জিত এই সেতু স্থাপনা সমূহ। যুগ সন্ধিক্ষণে তাল মিলিয়ে চলতে গিয়ে এদের অবস্থাও ভঙ্গুর ও জবুথবু।
আবার অনেক “সেতু” বা “পুল” স্থাপনা যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে না পেরে মিশে গেছে কালের অতল গহ্বরে। আজ এদের অস্তিত্ব ও বোঝা যায় না। যেমন : : খাঁজা আম্বার পুল , তাঁতীবাজার পুল, ইত্যাদি। মানুষ নির্মমভাবে পুরানো সেতু ভেঙ্গে নতুন সেতু স্থাপন করেছে তার উদাহরণ – ত্রিবেণী সেতু, কেল্লার পুল সেতু ইত্যাদি। যুদ্ধের ভয়াবহতা ও বিভীষিকাময় দিনগুলির শিকার ঐতিহাসিক তালতলা সেতু। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যেটির অবসান ঘটে। আর যেসব সেতু স্থাপনা এখনো টিকে রয়েছে, কে জানে, পরবর্তী ১০০ বছরে এদের কী হাল-হকিকত হবে ?
মুঘল আমলের সেতুসমূহ : সূচনা::
অতি-প্রাচীন কাল থেকে এই বাঙলা বৃহত্তর ভারতবর্ষের অন্তর্ভুক্ত ও শাসিত অঞ্চল ছিল। বাঙলার ইতিহাস পর্যবেক্ষণের ধারবাহিকতা থেকে আমরা দেখতে পাই –
- খ্রিষ্টপূর্ব ২৬৯ অব্দ থেকে ১২০০ খ্রিষ্টাব্দ = বৌদ্ধ যুগ
- খ্রিষ্টপূর্ব ২৬৯ অব্দ থেকে ১২০০ খ্রিষ্টাব্দ = হিন্দু যুগ
- ১২০০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৫২৬ খ্রিস্টাব্দ = সুলতানি যুগ
- ১৫২৬ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দ = মুঘল বা নবাবী যুগ
- ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত = বৃটিশ ঔপনিবেশিক আমল।
- ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত : : দেশভাগ, বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলন, ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ পূর্ববর্তী ও পরবর্তী অধ্যায়।
প্রতিটা সময় পাড় হয়েছে বিস্তর ক্রান্তিলগ্নের মধ্য দিয়ে। কোন সময়েই পথ -পরিক্রমা বিষয়টা বাদ দিয়ে হয় নি। কাফেলায় পথ ঘুরে ঘুরে যেমন পথিকেরা পথের সৃষ্টি করেছে তেমন পথে পথে নিজেদের নামাঙ্কিত করার জন্যে কূপ খনন ও জল সেচনের ব্যবস্থা, ঘাট নির্মাণ, সেতু নির্মাণ এসব কিছুই করেছেন।
কোথাও কোথাও দেখা মেলে খুব ছোট আকৃতির সেতুর সন্ধান যেগুলো কালের মানচিত্রে হয়তো তেমন জায়গা দখল করে রাখতে পারে নি। আবার সেতু সংলগ্ন দূর্গ বা, কেল্লা দেখে এদের অবয়ব বোঝা যায়। তবে সর্বযুগের সবচেয়ে আকর্ষণীয় মাধ্যম হচ্ছে রাস্তা ঘাট সংস্কার ও নির্মাণ।
যেমন : : এশিয়ার প্রাচীনতম সড়ক পথ “গ্রান্ড ট্রাঙ্ক রোড”। এই সড়কটি নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁও থেকে শুরু করে পশ্চিমবঙ্গের হাওড়া হয়ে পাকিস্তানের পেশাওয়ারের মধ্য দিয়ে আফগানিস্তানের কাবুল পর্যন্ত বিস্তৃত। এই সড়কের অপর নাম “সড়ক- এ- আযম”।
সুরি সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা “শের শাহ সুরি ” (১৪৮৬ খ্রিষ্টাব্দ – ১৫৪৫ খ্রিষ্টাব্দ) এই “গ্রান্ড ট্রাঙ্ক রোড” নির্মাণ করেন।
মুঘল আমলের সেতুসমূহ : রেনেলের মানচিত্র অনুযায়ী : :
বঙ্গ দেশের প্রাচীন মানচিত্রের উদ্যোক্তা জেমস রেনেল ( ১৭৪২ খ্রিষ্টাব্দ -১৮৩০ খ্রিষ্টাব্দ) । তিনি একজন ব্রিটিশ ভূবিদ, ভূগোলবিদ, ইতিহাসবেত্তা ও নৌ-প্রকৌশলী। রেনেল কে মহাসমুদ্রবিদ্যার জনক বলা হয়। বঙ্গীয় নদীব্যবস্থার উপরে সুনির্দিষ্ট জরিপ, তথ্যচিত্র ও মানচিত্র করার জন্যে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তাকে দায়িত্ব দেন। জেমস রেনেল টানা ১০ বছরে এই কাজটি রপ্ত করেন অর্থাৎ, ১৭৬৩ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১৭৭৩ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত তিনি ব্রিটিশ সরকারের অধীনে বাংলার মানচিত্র প্রস্তুত করেন।
রেনেল এর মানচিত্রে বঙ্গীয় স্থাপনার দেখা মেলে। প্রাচীন এই ম্যাপে যেমন কালজয়ী দূর্গের সন্ধান মেলে তেমন বহু সেতু স্থাপনার তথ্য মেলে। রেনেল এর মানচিত্র অনুযায়ী সেতুর পরিচয় ও অবস্থান জানা যায়।
রেনেল এর ম্যাপ অনুযায়ী প্রাচীন সেতু স্থাপনার নাম : :
- টঙ্গি সেতু
- খাঁজা আম্বর সেতু
- পাগলা পুল
- গেন্ডারিয়া পুল
- কদমপুর পুল
বাস্তব পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে প্রাচীন সেতু : :
কিন্তু, বাস্তব টা অতোদিনে অনেক দূর পৌঁছে গেছে। অনেক স্থানের নাম বদলে গেছে তাই ম্যাপ অনুযায়ী নাম মিলানো কঠিন ও দুরূহ ব্যাপার।
যেমন : :
রেনেল এর ম্যাপে, কদমপুর পুলের নাম আছে কিন্তু বাস্তবে যে তা কোথায় তার হদিস মেলে না।
ম্যাপ অনুযায়ী সোনাকান্দা কেল্লা ও খিজিরপুর কেল্লার মধ্যবর্তী একটি স্থানে এই কদমপুর পুল অবস্থিত। বাস্তব পর্যবেক্ষণে কদমপুর নামের অস্তিত্ব পাওয়া যায় না। সোনাকান্দা ও খিজিরপুর (বর্তমান : : হাজীগঞ্জ) এর মধ্যবর্তী স্থানটি যতটা সম্ভব প্রাচীন কত্রাভু (বর্তমান : : নবীগঞ্জ ) কে নির্দেশ করে। নবীগঞ্জ এর পার্শ্ববর্তী ইস্পাহানি এলাকায় আরেকটি মুঘল আমলের পুল বা সেতুর দেখা মেলে। যার অপর নাম ” চাপাতলির ইটের পুল” । স্থানীয় লোকজনের মতে এই স্থানের নাম কখনোই কদমপুর ছিল না। কিংবা প্রাচীন ইতিহাসে এই নাম নেই। আবার , রেনেল এর ম্যাপে চাপাতলির ইটের পুল এর নাম নেই। সোনাকান্দা কেল্লা সমেত স্থানে “ত্রিবেণী খাল” ও “ত্রিবেণী পুলের” অস্তিত্ব আমি শৈশব থেকে দেখতে দেখতে অভ্যস্ত। যদিও বর্তমানে ত্রিবেণী পুল ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে। আবার, খিজিরপুর কেল্লা (বর্তমান হাজীগঞ্জ দূর্গ) সমেত স্থানে “কেল্লার পুল” এর নবনির্মিত ও রূপান্তরিত স্থাপনা বিদ্যমান। এখন প্রশ্ন হলো –
প্রশ্ন : : ০১। কদম পুর পুল ই কী চাপাতলীর ইটের পুল ? হয়তো, চাপাতলী গ্রামের পূর্ববর্তী নাম ছিল কদম পুর গ্রাম। যদিও এর ভিত্তি নেই।
প্রশ্ন : : ০২। কদমপুর নামে গ্রামে অবস্থিত কদমপুর পুল। যদিও কদম পুর গ্রামের সন্ধান পাওয়া যায় নি।
প্রশ্ন : : ০৩। কদমপুর পুল ই কী ত্রিবেণী পুল ? বা, কেল্লার পুল ? কিন্তু তাদের নাম তো শুরু থেকেই স্ব-স্ব নামে পরিচিত।
প্রাচীন এই ম্যাপে অনেক সেতুর নাম উল্ল্যেখ নেই কিন্তু ইতিহাসে তার প্রমান মেলে। যেমন : : চাপাতলীর ইটের পুল, কেল্লার পুল, ত্রিবেণী পুল।
যদিও বর্তমানে কেল্লার পুল, ত্রিবেণী পুল কে নিশ্চিহ্ন করা হয়েছে। পুরানো এই পুল ভেঙ্গে নতুন সড়ক সেতু তৈরী হচ্ছে।
পর্যাপ্ত পরিমান গবেষণা, ইতিহাসের নিরীখে তথ্য যাচাই -বাছাই করে লব্ধ আজকের ঐতিহাসিক সেতুর তালিকা:
- পানাম সেতু, পানাম নগরী সংলগ্ন
- দালালপুর পুল, সোনারগাঁও
- পানাম নগর সেতু, সোনারগাঁও
- পিঠাওয়ালীর পুল, সোনারগাঁও
- ত্রিবেণী পুল,সোনাকান্দা দূর্গ সংলগ্ন
- কেল্লার পুল,খিজিরপুর দূর্গ সংলগ্ন
- ত্রিমোহনী পুল,আমুলিয়া বাজার সংলগ্ন, রূপগঞ্জ
- কদমপুর পুল
- চাপাতলীর ইটের পুল,প্রাচীন কত্রাভু সংলগ্ন
- পাগলা পুল,পাগলা, বেগ মুরাদের দূর্গ সংলগ্ন
- খাঁজা আম্বার পুল
- তাঁতিবাজার পুল
- টঙ্গী পুল, টঙ্গী-আব্দুল্লাহপুর সড়ক সংলগ্ন
- পুলঘাটা পুল, মীরকাদিম, ইদ্রাকপুর দূর্গ সংলগ্ন
- তালতলা পুল
- বাড়িউড়া প্রাচীন পুল, হাতিরপুল, ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়া
মুঘল আমলের সেতুসমূহ : “সেতু” বা “পুল” এর ম্যাটেরিয়াল::
সুলতানি, মুঘল ও ঔপনিবেশিক আমলের এই সেতু বা, পুল স্থাপনা সমূহ প্রধানত ইটের তৈরী। বিশেষত পোড়ামাটির তৈরী ইট এবং চুন মর্টার ইট ব্যবহৃত হতো। যেসব রাজমিস্ত্রিগণ এই স্থাপনা তৈরী করতো তাদের বেশিরভাগই আগ্রা,দিল্লি, ঝাড়খন্ড, রাজমহল থেকে আনয়ন করা।
শুধুমাত্র সেতু বা পুল নির্মাণে ইটের এই ব্যবহার যে প্রকট ছিল তা নয়। বরঞ্চ, প্রাচীন পথ ঘাট তথা রাস্তা নির্মাণ, ইমারত ও মসজিদ নির্মাণের স্থাপত্য শৈলীর প্রধান উপকরণ ছিল এই ইট।
যেমন –
- প্রাচীন বাংলার রাজধানী “পুন্ড্রু বর্ধন” বা, “পুন্ড্রু নগর” এর উত্খননে প্রাপ্ত পথঘাট,সোপান ও ভিটি সবই ইটের তৈরী।
- আবার, ৩০০০ বছর আগের স্থাপনা “ওয়ারী-বটেশ্বরে” খননে প্রাপ্ত পথ, ঘাট, দেয়াল সবই লাল ইটের তৈরী
- ঐতিহ্যবাহী প্রাচীন শহর “পানাম নগরী” এর স্থাপনা সমূহ ইটের তৈরী।
প্রাচীন এই ইটের যোগান::
এই বাংলায় ইটভাটার ব্যবহার অনেক পরে এসেছে।
শুরুতে, ইট-ভাটার অস্তিত্ব ছিল না, তাহলে এতো ইট এলো কোথা থেকে ?
প্রাচীন এই স্থাপনা সমূহের ইট নির্মিত হত মাটি দিয়ে। এতো মাটির যোগান ই বা হতো কিভাবে ?
তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ হলো -খাল, পুকুর বা নালা খনন করে মাটির পর্যাপ্ত ব্যবস্থা করা ও পানিভর্তি দীঘি করে জলযোগের সুব্যবস্থা করা। উদাহরণ স্বরূপ- ধর্মীয় শাসক খান জাহান আলী এই বাংলায় মসজিদের শহর “খলিফাতাবাদ” গড়ে তোলেন। তিনি এই শহরে অসংখ্য মসজিদ স্থাপনা গড়ে তোলেন। প্রতিটা মসজিদ সংলগ্ন স্থানে তিনি এক- একটি পুকুর বা দীঘি খনন করেন। ঐসব দীঘি থেকে প্রাপ্ত মাটি আহরণ করে প্রক্রিয়াজাত করে ইট নির্মাণ করা হত ও এইসব স্থাপনায় ব্যবহার করা হতো।
তেমনি মুঘল আমলে এই যে বড় বড় কেল্লা বা দুর্গ গড়ে উঠতো এগুলোর প্রতিটির সংলগ্ন স্থানে
রয়েছে এক একটি জলাধার। এসব জলাধার থেকে প্রাপ্ত মাটি দিয়ে তৈরী হতো কেল্লার এক একটি দেয়ালের গাঁথুনি। সুতরাং, প্রাচীন বাংলার স্থাপনা নির্মাণে ইটের কোন বিকল্প নেই।
যেমন : : “সোনাকান্দা দূর্গ” সমেত স্থানে “ত্রিবেণী খাল”,”হাজীগঞ্জ দুর্গ” সমেত স্থানে “কেল্লার পুল খাল”, “টঙ্গি সেতু” সমেত স্থানে “টঙ্গি খাল” ইত্যাদি ইত্যাদি।
তাছাড়া, সুলতানি আমলের স্থাপত্য নির্মাণের প্রধান হাতিয়ার ছিল এই ইট। যদিও মুঘল আমলে পলেস্তরা বা আস্তরণ এর ব্যবহার সর্বাধিক হয়। আমরা, প্রাচীন বাংলার সেতু বা পুল স্থাপনায় দুই রকম ব্যবহার দেখতে পাই। প্রাথমিক অবস্থায় ইটের ব্যবহার ও পরবর্তীতে পলেস্তরা আস্তরণ করা।
মুঘল আমলের সেতুসমূহ : সেতু’র গাঠনিক বৈশিষ্ট্য ও স্ট্রাকচার ভাবনা:
সেতুর নকশা ::
- প্রতিটা সেতুর “প্ল্যান” বা, “নকশা” সরলরৈখিক আকৃতির।
- প্রতি সেতুর “প্ল্যান ” বা, “নকশা” লম্বাটে, দীর্ঘ আকৃতির।
- প্রতি সেতুর “প্রস্থ” অপেক্ষাকৃত কম, দৈর্ঘ্য অনেক বেশি।
- প্রতি সেতুর মধ্যবিন্দু ‘তে অর্থাৎ কেন্দ্রস্থল একটু উঁচু।
- সেতুর উপরিভাগ থেকে ঢালু হয়ে নিচে নেমে গেছে।
- সেতুর “প্ল্যান ” বা “নকশা” তে খিলানের পিলার এর অস্তিত্ব দেখা যায়।
সেতুর এলিভেশন
- বেশিরভাগ সেতু ত্রি-খিলানযুক্ত। আবার, কতক সেতু একটি মাত্র খিলান বিশিষ্ট হয়।
- ত্রি-খিলানযুক্ত সেতুতে মধ্যবর্তী খিলানটি অপেক্ষাকৃত বড় আকৃতির হয়। একটিমাত্র খিলানযুক্ত সেতুতে খিলান সর্বাধিক বড় আকৃতির হয়। জলপথে এই খিলানের মধ্য দিয়ে জলযান তথা – নৌকা, ডিঙ্গি, পানশি যাতায়াত করে। পার্শ্ববর্তী খিলান দুটো অন্ধকারাচ্ছন্ন সরি গলিময়। যা দিয়ে সর্বোচ্চ মাছের এপার থেকে ওপারে যেতে পারে। আবার কোন-কোন ক্ষেত্রে পার্শ্ববর্তী খিলানের আকৃতি অপেক্ষাকৃত বড় আকৃতির হয় তবে তা মধ্যবর্তী খিলান থেকে অনেক ছোট।
- প্রতিটা খিলান সম্বলিত সেতু প্রাচীর এর পুরুত্ব ও ঘনত্ব অনেক বেশি। বিশেষত সেই সময়ে কলাম স্ট্রাকচার এর ব্যবহার এতটা আমুদে হয়নি বলেই এই পুরু দেয়ালের আবির্ভাব।
- সেতু বা পুলের শেষ থেকে শুরু পুরোটাই ইট নির্মিত।
- সেতু বা পুলের জ্যামিতিক কনফিগারেশন অনুযায়ী এতটাই বক্রভাবে লাভ করে যে অনেক ক্ষেত্রে ভারী যানবাহন উপর দিয়ে চলাটা কঠিন ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। সেক্ষেত্রে পায়ে হেটে সেতু পথ পারি বা ঘোড়ার গাড়ি চলাচলের বিকল্প নেই। আর এই পয়েন্ট টিতেই প্রাচীন সময় ও বর্তমান সময়ের যানবাহনের একটা বিস্তীর্ণ ফারাক দেখা যায়।
- সেতু বা পুল গুলো সব সমসাময়িক গোত্রের। কোনটাই কারো চেয়ে বড় বা ছোট মনে হয় না। যেহেতু খুব বেশি দীর্ঘ পরিমান স্ট্রেইট নিতে অক্ষম তাই সেতুর দৈর্ঘ্য ও খুব কম।
- সেতুর উপরিভাগের কেন্দ্রস্থল মধ্যবর্তী স্থান থেকে সুই পার্শ্বে ক্রমশ ঢালু হয়ে নেমে গেছে।
- সেতুর দুইপার্শ্বে যে রেলিং এর ব্যবহার, তার উচ্চতা খুব কম। উচ্চতা অনুযায়ী রেলিং এর উপরিভাগে কোনাকৃতি তৈরী হয় যা দেখতে একটা ত্রিভুজের মতো।
- কতিপয় সেতুতে চারিপার্শ্বে অক্টাগোনাল টরেন্ট বা বুরুজ দেখা যায়। যার উচ্চতা উপরিভাগে পৌঁছায় না।
- কখনো কখনো মূল খিলান ছাড়াও অতিরিক্ত খিলান এর দেখা মেলে। যেমন : : পাগলা সেতু।
- আবার কোন কোন ক্ষেত্রে সেতুর চারপাশে মিনার দেখা যায়। এদের সংখ্যা একের অধিক হয়। যেমন : : পাগলা সেতু। পাগলা সেতুতে প্রতিটি কোণায় চারটি মিনার দেখা যায়। যাদের আকার অষ্টভুজাকার।
- কখনো কখনো টিউডার গথিক স্থাপত্যের পরিচয় মেলে।
- প্রতিটা সেতু এক-একটা ইতিহাস, সেতু সংলগ্ন খাল বা পরিখা ও এক-একটা ইতিহাসের সাক্ষী। আবার অনেকে স্থানে সেতু সমেত স্থান জুড়ে আছে দূর্গ বা কেল্লা।
……….চলবে.……… পরবর্তী পর্ব
One thought on “মুঘল আমলের সেতুসমূহ পর্ব-১”
Comments are closed.