আমরা যখন স্থাপত্যে পড়তাম
আমরা যখন স্থাপত্যে পড়তাম
[লিখেছেন: স্থপতি পৃথা শারদী, সহকারী স্থপতি, স্থাপত্য অধিদপ্তর, ঢাকা, বাংলাদেশ।]
আমরা যখন স্থাপত্যে পড়তাম, তখন আমাদের হাতে মাঝেমাঝে টাকা তো দূরে থাক পয়সাও থাকত না, তখন আমরা রাত ৩ টার দিকে ঘুমাতাম আবার ৭ টার দিকে উঠতাম,উঠে থিওরি ক্লাস করার জন্য দৌড় মারতাম,থিওরি ক্লাসের শেষে ১০ টা থেকে শুরু হত ডিজাইন ক্লাস, আমরা ছোট্ট ছোট্ট মাস মডেল নিয়ে আসতাম,কারো টা থাকত জুতার বাক্সের মত, কারোটা ডিমের মত, স্যারদের কাছে প্রিলি করতে যেতাম, সেখানে গিয়ে আমাদের ডিজাইনগুলো বেশিরভাগ সময়ই বাদ দিয়ে দেয়া হোত, আমরা তাও দাত ক্যালায় হাসতে থাকতাম, প্রথমদিন কারো ডিজাইন সিলেক্ট হলে আমরা তাকে সমবেদনা জানাতাম কারণ পরের প্রিলিতে তার ডিজাইন আগে বাতিল হয়ে যেত।
আমাদের ক্লাসে কেউ কেউ ছিল চরম লুথা, কেউ চরম আটি, তবে আমরা সবাই ই চোথা একটু আধটু মারতাম, মেরে বলতাম, inspired হয়েছি, আমাদের কেউ কেউ ক্লাসে এসেই অন্যের ভুল ধরত যারা নিজেরা ছিল “তলাফাকা ঝুড়ি “, কেউ কেউ ক্লাসে এসেই ডিজাইন দেখাতে ব্যস্ত হয়ে যেত আর কেউ কেউ আসতই না, শুধু প্রিলির দিন মুখ দেখাত।
তবে আমরা বিপদে পড়লে একিসাথে পড়তাম, আমরা গনহারে ক্লাস বাংক দিতাম, কেউ না দিতে চাইলে ঘাড়ে ধরে তারে ক্লাসের বাইরে নিয়ে যেতাম, চামড়া আমাদের এতই মোটা ছিল যে স্যার ম্যাডামরা যাই বলতেন না কেন একটু মুখ কালো করে রেখে পরেই আমরা বলতাম, দোস্ত, কই খাইতে যাবি!
আমরা যখন স্থাপত্যে পড়তাম
গ্রুপ প্রজেক্ট গুলাতে আমরা কি না করতাম,অশ্লীল নাচ গান, ভোর পাঁচটায় খিচুড়ি খাওয়া, ঝগড়াঝাটি ক্যাও ক্যাও ভ্যাও ভ্যাও টাকা পয়সার হিসাব সব ছিল এইসবে।:(
অনেকে স্থাপত্যকে গাজা খাওয়া বিষয় ভাবেন, আমরা যে হারে কাজ করতাম, আমাদের গায়ে মাস্কিং টেপ উহু লেগে থাকত, না ঘুমাতে ঘুমাতে চোখ জবা ফুলের মত লাল হয়ে থাকত, দেখতে গাঞ্জুট্টি টাইপ লাগলেও আসলে বলার কিছু থাকত না আমাদের।জুরির দিন আমাদের দেখতে লাগত মাতালের মত, বাসায় এসে আমরা টাল হয়ে ঘুমাতাম, কেউ ডাকত না আমাদের।
সবাই স্নাতক করে চার বছরে আমরা করি টানা পাচ বছরে,সবাই ভাবে এক বছর ফেল করেছি আমরা তখন বুঝিয়ে বলি কোর্সটাই পাচ বছরের, পাগলের মত খাটতাম আমরা, পয়সা ঢালতাম, তাও জুড়িতে ফেল আসত,কি দশা!
আমরা যখন স্থাপত্যে পড়তাম
আমাদের সিজিপিএ তলানিতে, লজ্জায় বলা যায় না মাঝে মাঝে! কেন? ডিজাইনের চাপে। কেউ কি জানে এসব কথা?????
চাকরির শুরুতে বেতন কত???? জানতে চেয়ে লজ্জা দেবেন না।
প্রাকটিকেল কাজের ধরন আলাদা,স্থপতি ইন্সটিটিউটের সদস্য হতে হলে একটা পরীক্ষা দিতে হয়, একজন স্থপতির অধীনে কাজ করতে হয়, পাচটা বছর আমরা গাধার খাটা খাটি, তাও একটা ডিজাইন করে তাতে নিজের নাম বসাতে পারিনা, নামের আগে স্থপতি লিখতে গেলে, আরো কয়েক বছরের অপেক্ষা, পাশ করেও শান্তি ঠিক পাওয়া যায় না।
কেউ কি বিশ্বাস করবে, রাত ৩ টার সময় দিয়ে একদল আধপাগল ছেলেমেয়ে রাতের ঘুম বাদ দিয়ে নীলক্ষেত ধানমন্ডি তে প্লটারে ৭০০০ টাকার প্রিন্ট দিচ্ছে???????
কেউ কি জানবে কখনো, একটা মেয়ে জ্বরে টাল হয়ে হল ভর্তি জুরারের সামনে সবকিছু বাদ দিয়ে চাপা পিটায় যাচ্ছে, শুধুমাত্র ৪০ পাবার আশায়?????
কেউ কি জানবে, স্থাপত্য নামের শব্দটার কোন তুলনা হয় না,পার্সোনাল লাইফে ঝড় বয়ে গেলেও স্থাপত্যতে একটাই সমাধান, “সেমিস্টার ড্রপ দাও”
আমরা গান করি, আমরা নাচি, আমরা ছবি আকি, আমরা রাতের পিনপতন নীরবতা থেকে ভোর দেখি ল্যাপটপের দিকে তাকায় প্ল্যান সেকশন করতে করতে, আমাদের তুলনা আমরাই,শুধুমাত্র আমরা!
আমরা যখন স্থাপত্যে পড়তাম
সবাই স্থাপত্যকলার এইসব গাঞ্জা খাওয়া চেহারা দেখে, কেউ কি এগুলো দেখে না ছেলে মেয়ে গুলো টাকা জলের মত খরচ করে যাচ্ছে! আজকে একটা ডিজাইন করতে গেলে বলে কি পড়স পাচ বছর! ফ্রি তে করে দাও! কেন রে ভাই! পড়ার কি কোন মূল্য নাই,এত এত এত কষ্ট করে পড়লাম তার কোন কি দাম নাই! নাকি সুন্দর ভাবে লিপিস্টিক দিয়ে সেজে বা কোট টাই পড়ে তথাকথিত প্রেজেন্টেশন করলাম না দেখে মূল্য দেয়া হলো না!
আমরা লড়াকু হয়ে গেছি নিজেদের সাথে লড়তে লড়তে,স্থাপত্য নামের লড়াকু বিষয়কে পোষ মানাতে। স্থাপত্যখুব কঠিন বিষয়। না জেনে বুঝে এটা নিয়ে কথা বলা উচিত না।শ্রমের মূল্য সবার চায়,মানসিক শ্রমও তো শ্রম, না? ফাইল সই করার মতন,রোগীর নাড়ী টিপে দেখার মতন, একটা ঘরের দরজা জানালাও বুঝে শুনে আমরা দেই,ঘর নকশা করা সহজ নয়,ভেবে দেখুন জানালাটা যদি দখিনমুখী না করে পশ্চিমমুখী করে দেই তো? আমার চাপার বাড়িতে হয়তো আপনি তা বুঝলেন ই না কোথায় কি করে দিলাম আপনার স্বপ্নের বাড়িতে!
পাচটা বছর খেটে যেতে হয়,অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হয় এই স্থাপত্যকলার কৌশল বুঝতে, তাকে ধারণ করতে, কেন আপনারা বোঝেন না??????
কেন? কেন? কেন?????
2 thoughts on “আমরা যখন স্থাপত্যে পড়তাম”