মুঘল আমলের সেতুসমূহ পর্ব-২
মুঘল আমলের সেতুসমূহ পর্ব-২
শাহরিয়ার হাসান মৃধা রাতুল, প্রধান স্থপতি, মৃধা’জ ড্রয়িং হাউজ, নারায়ণগঞ্জ
মুঘল আমলের সেতুসমূহ –“ঐতিহাসিক: “সেতু” অথবা, “পুল” স্থাপনার হালখাতা। ফিরে দেখা সেকাল:বাস্তব পর্যবেক্ষণ ও যুগোপযোগী চিন্তা-ভাবনা।
মুঘল আমলের সেতুসমূহ : সেতু’র গাঠনিক বৈশিষ্ট্য ও স্ট্রাকচার ভাবনা:
সেতুর নকশা ::

- প্রতিটা সেতুর “প্ল্যান” বা, “নকশা” সরলরৈখিক আকৃতির।
- প্রতি সেতুর “প্ল্যান ” বা, “নকশা” লম্বাটে, দীর্ঘ আকৃতির।
- প্রতি সেতুর “প্রস্থ” অপেক্ষাকৃত কম, দৈর্ঘ্য অনেক বেশি।
- প্রতি সেতুর মধ্যবিন্দু ‘তে অর্থাৎ কেন্দ্রস্থল একটু উঁচু।
- সেতুর উপরিভাগ থেকে ঢালু হয়ে নিচে নেমে গেছে।
- সেতুর “প্ল্যান ” বা “নকশা” তে খিলানের পিলার এর অস্তিত্ব দেখা যায়।
সেতুর এলিভেশন

- বেশিরভাগ সেতু ত্রি-খিলানযুক্ত। আবার, কতক সেতু একটি মাত্র খিলান বিশিষ্ট হয়।
- ত্রি-খিলানযুক্ত সেতুতে মধ্যবর্তী খিলানটি অপেক্ষাকৃত বড় আকৃতির হয়। একটিমাত্র খিলানযুক্ত সেতুতে খিলান সর্বাধিক বড় আকৃতির হয়। জলপথে এই খিলানের মধ্য দিয়ে জলযান তথা – নৌকা, ডিঙ্গি, পানশি যাতায়াত করে। পার্শ্ববর্তী খিলান দুটো অন্ধকারাচ্ছন্ন সরি গলিময়। যা দিয়ে সর্বোচ্চ মাছের এপার থেকে ওপারে যেতে পারে। আবার কোন-কোন ক্ষেত্রে পার্শ্ববর্তী খিলানের আকৃতি অপেক্ষাকৃত বড় আকৃতির হয় তবে তা মধ্যবর্তী খিলান থেকে অনেক ছোট।
- প্রতিটা খিলান সম্বলিত সেতু প্রাচীর এর পুরুত্ব ও ঘনত্ব অনেক বেশি। বিশেষত সেই সময়ে কলাম স্ট্রাকচার এর ব্যবহার এতটা আমুদে হয়নি বলেই এই পুরু দেয়ালের আবির্ভাব।

- সেতু বা পুলের শেষ থেকে শুরু পুরোটাই ইট নির্মিত।
- সেতু বা পুলের জ্যামিতিক কনফিগারেশন অনুযায়ী এতটাই বক্রভাবে লাভ করে যে অনেক ক্ষেত্রে ভারী যানবাহন উপর দিয়ে চলাটা কঠিন ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। সেক্ষেত্রে পায়ে হেটে সেতু পথ পারি বা ঘোড়ার গাড়ি চলাচলের বিকল্প নেই। আর এই পয়েন্ট টিতেই প্রাচীন সময় ও বর্তমান সময়ের যানবাহনের একটা বিস্তীর্ণ ফারাক দেখা যায়।
- সেতু বা পুল গুলো সব সমসাময়িক গোত্রের। কোনটাই কারো চেয়ে বড় বা ছোট মনে হয় না। যেহেতু খুব বেশি দীর্ঘ পরিমান স্ট্রেইট নিতে অক্ষম তাই সেতুর দৈর্ঘ্য ও খুব কম।
- সেতুর উপরিভাগের কেন্দ্রস্থল মধ্যবর্তী স্থান থেকে সুই পার্শ্বে ক্রমশ ঢালু হয়ে নেমে গেছে।

- সেতুর দুইপার্শ্বে যে রেলিং এর ব্যবহার, তার উচ্চতা খুব কম। উচ্চতা অনুযায়ী রেলিং এর উপরিভাগে কোনাকৃতি তৈরী হয় যা দেখতে একটা ত্রিভুজের মতো।
- কতিপয় সেতুতে চারিপার্শ্বে অক্টাগোনাল টরেন্ট বা বুরুজ দেখা যায়। যার উচ্চতা উপরিভাগে পৌঁছায় না।

- কখনো কখনো মূল খিলান ছাড়াও অতিরিক্ত খিলান এর দেখা মেলে। যেমন : : পাগলা সেতু।
- আবার কোন কোন ক্ষেত্রে সেতুর চারপাশে মিনার দেখা যায়। এদের সংখ্যা একের অধিক হয়। যেমন : : পাগলা সেতু। পাগলা সেতুতে প্রতিটি কোণায় চারটি মিনার দেখা যায়। যাদের আকার অষ্টভুজাকার।
- কখনো কখনো টিউডার গথিক স্থাপত্যের পরিচয় মেলে।
- প্রতিটা সেতু এক-একটা ইতিহাস, সেতু সংলগ্ন খাল বা পরিখা ও এক-একটা ইতিহাসের সাক্ষী। আবার অনেকে স্থানে সেতু সমেত স্থান জুড়ে আছে দূর্গ বা কেল্লা।

সোনারগাঁওয়ে অবস্থিত প্রাচীন বাংলার সেতু স্থাপনা সমূহ : :
প্রাচীন বাংলার রাজধানী “সোনারগাঁও”(১২৮১ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১৬১০ খ্রিষ্টাব্দ)।যা নারায়ণগঞ্জ এর উপজেলা। ঢাকা থেকে ২৭ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত এই রূপকথার রাজ্য। অধ্যাপক স্বরূপচন্দ্র রায় তার বইতে এই স্থানকে “সুবর্ণগ্রাম” নামে অভিহিত করেছেন। বাংলার বার ভূঁইয়া খ্যাত “ঈশা খান ” এর সাম্রাজ্য এই প্রাচীন “সুবর্ণগ্রাম”। আর পানাম নগরী হলো এই প্রাচীন সোনারগাঁওয়ের অন্তর্গত পরিত্যক্ত এক নগরী। মুঘল শাসনামলে নগরায়নের প্রক্রিয়া অনুসরণ করে এই স্থানগুলোতে গড়ে উঠেছে হরেক রকম স্থাপনা।
সোনারগাঁওয়ের এই ঐতিহাসিক স্থাপনাসমূহের মধ্যে রয়েছে – প্রাচীন ইমারত, ক্রোড়ী বাড়ি,সেতু ,ঘাট, মসজিদ, পরিখা, মঠ, নীল কুঠি, কুঠি বাড়ি, দরবার হল, রঙমহল, টাকশাল ও মাদরাসা। মুঘলরা এই বাংলায় যে কয়টি নান্দনিক সেতু স্থাপনা তথা পুল নির্মাণ করেছে তার মধ্যে এই স্থাপনাটি অন্যতম।
মুঘলরা সোনারগাঁও অধিকার করার পরে ১৬১১ খ্রিস্টাব্দে প্রাচীন সোনারগাঁয়ের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করার জন্য পানাম নগরীর আশেপাশে অনেক মহা সড়ক ও সেতু নির্মাণ করেন।
এদের মধ্যে যা কিছু অবশিষ্ট তা এখনো পর্যটক ও পুরাতকত্ববিদগণের মনে বিষ্ময়ের উদ্রেক করে। এখানে সেতু তাদের মধ্যে রয়েছে –
- পানাম সেতু
- দালালপুর পুল
- পানাম নগর সেতু
- পিঠাওয়ালীর পুল
……….চলবে.……… পূর্ববর্তী পর্ব