কলকাতার জাকারিয়া স্ট্রীট এর নাখোদা মসজিদ
কলকাতার জাকারিয়া স্ট্রীট এর নাখোদা মসজিদ
[লেখকঃ শাহরিয়ার হাসান মৃধা রাতুল, স্থপতি, মৃধা’জ ড্রইং হাউজ, নারায়ণগঞ্জ, ঢাকা, বাংলাদেশ।]
কলকাতার জাকারিয়া স্ট্রীট এর নাখোদা মসজিদ: ঔপনিবেশিক আমলে এই বাংলায় ব্রিটিশদের উত্থান ঘটে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির এক চেটিয়া অধিকরণের ফলে ব্রিটিশ‘রা ভারতীয় উপমহাদেশে শাসন ব্যবস্থা শুরু করে। ১৬০০ খ্রিষ্টাব্দে শুরু করে ১৮৫৮ খ্রিষ্টাব্দের আগ পর্যন্ত এই শাসন ব্যবস্থা বজায় থাকে। ব্রিটিশ আমল থেকেই মসজিদের শহর কলকাতা।
কোলকাতার সবচেয়ে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হলো, –
- বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার নবাব সিরাজৌদোল্লাহ কর্তৃক কোলকাতা দখল
- সম্রাট টিপু সুলতানের বংশধরদের নির্বাসনে পাঠানো
- সিপাহী বিদ্রোহের পর বাদশা ওয়াজিদ আলি শাহকে বন্দি করে শহরে পাঠানো
এই তিনটি সময়ে মুসলিমদের জন্য প্রয়োজন পড়ে মসজিদের৷ অঞ্চলভেদে একটি নয়, বহু মসজিদ গড়ে উঠে। মূলত ইতিহাসের ঘটনাগুলোর সহযাত্রী হলো এক একটা মসজিদ। তেমনি কলকাতার প্রধান মসজিদ “নাখোদা মসজিদ “।বলা চলে ভারতীয় উপমহাদেশের সর্বাপেক্ষা বড় মসজিদ এটি।
কলকাতায় অবস্থিত নাখোদা মসজিদ স্থাপনার একাংশ
এপার বাংলা থেকে ওপার বাংলায়
রাত তখন আট’টা বাজে। মৈত্রী ট্রেন এসে কলকাতায় থামলো। লেখক দাদু, দীদান দুজনেই খুব ক্লান্তl আমি কিছুটা উৎফুল্ল। এই প্রথম আমার বিদেশ বিভুঁই এ পা রাখাl তাও যে দেশের ইতিহাস ও ঐতিহাসিক স্থাপনার বহু গল্প শুনেছি, সেই ভারতের মাটিতে।
অনেক কুলি এগিয়ে এলো, দাদু বলল লাগবে না। আবার অনেক ড্রাইভার ও এগিয়ে এলো ব্যাগ তুলে নিতে, দাদু তাদের ও না বললো। আমিতো অবাক! তবে কি দাদু পায়ে হেঁটে গন্তব্যে যাবেন ?নাকি কাছে কোথাও উঠবো ? দাদু বলল, লাইন এ দাড়াও গিয়ে, প্রিপেইড কার এ যাবো l
প্রিপেইড কার এর জন্য ওয়েটিং এ দাড়ালাম আমরাl
প্রচন্ড ঝড়ো হাওয়া বইছে। এখুনি বিশাল ঝড় বৃষ্টি আরম্ভ হবে বলে মনে হচ্ছে। স্থানীয় একজন বললো এমন ঝড়ো হাওয়া কখনো নাকি দেখে নি সে। আমার তার কথা বিশ্বাস করতে কষ্ট হলো। এতো জোরে অশান্ত বাতাস বইছে ! ধূলি কণা এসে চোখে ঢুকতে লাগলো। তবুও ভালো লাগছিলো। আমি দাদুকে বললাম, আমরা বাংলাদেশ থেকে ঝড় ঝঞ্ঝা নিয়ে এসেছি।
আমাদের সিরিয়াল এর ট্যাক্সি চলে এলো। ভাড়ার পরিমান খুবই কমl আমাদের প্রথম যাত্রা জাকারিয়া স্ট্রীট। ড্রাইভার এর চোখে মুখে দেখলাম অসন্তোষের ভাব। মনে হয়, ভাড়া মুখে উঠে নি।
গাড়িতে উঠতেই আমি দাদুকে প্রিপেইড কার এর কথা জিজ্ঞেস করলাম। দাদু বললেন এই দেশে এই নিয়ম চলে। প্রিপেইড কার এর অফিস এ অগ্রিম টাকা দিতে হয়। অফিসার লোকজন গন্তব্যস্থলের নির্দিষ্ট ভাড়া ঠিক করে দেয় আর গাড়ির নাম্বার দিয়ে দেয়। ওই গাড়ি এই নিয়ম মানতে বাধ্য। নইলে জেল,জরিমানা ইত্যাদি। এক্ষেত্রে যা হয় ড্রাইভার’ রা ইচ্ছামতো ভাড়া আদায় করতে পারে না। তবে হ্যা, তাদের জন্য ব্যবস্থা আছে যদি কোনো যাত্রী সিরিয়াল এ দাঁড়াবে না বলে ঠিক করে আর গাড়ি নিয়ে যেতে চায় তবে তাদের থেকে ড্রাইভার রা নির্দিষ্ট ভাড়া না নিয়ে কম বেশি নিতে পারে। আমি বললাম, বাহ্ খুব ভালো আইন তো এই দেশেl আমাদের দেশে এই রকম হলে অনেক ভালো হতো।
গাড়ির জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছি। এই হলো পশ্চিমবঙ্গ। আমাদের বাংলার মিতা। পশ্চিম বঙ্গ। আমি তার উপরেই আছি। বাইরের দেয়ালে যে পোস্টার সাঁটানো। তাতে একবার হিন্দি লেখা, একবার ইংলিশ লেখা আবার বাংলায় লেখা। আমি আস্তে আস্তে বাংলার বিস্তৃতি দেখতে পাচ্ছি। বেশ কয়েক জায়গায় দেখলাম আমাদের প্রিয় শিল্পী রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যার ছবি। উনিতো এখন দুই বাংলার শিল্পী।
আধ ঘন্টার মধ্যেই গাড়ি এসে থামল জাকারিয়া স্ট্রীট এ। আমি ভেবেছিলাম, জাকারিয়া স্ট্রীট হয়তো হিন্দু জনবসতি হবে। কিন্তু, একি দেখছি ? এতো মুসলমান! একজন, দুজন নয়, শত-শত, হাজার-হাজার l সবার মুখেই দাড়ি। বেশিরভাগের গায়ে আলখেল্লা। আবার কেউবা পাঞ্জাবি,কুর্তা,মাথায় টুপি। মুসলিম উম্মাহর এক বিশাল জনসমুদ্দুর। এদের কারো কারো সাথে এক আধটু কথা হচ্ছিলো আমারl”কাহাঁ লজ পানে কে লিএ?” অর্থাৎ ,” কোথায় লজ পাবো?” (আমি কিন্তু একটু আধটু করে হিন্দি বলা শুরু করেছি) l দেখলাম এরা ভালো বাংলা জানেl একজন বললো,সামনেই পেয়ে যাবেন lআমি’তো অবাক। আমি খুশি হয়ে বললাম, আপনি বাংলা জানেন ? আপনি কি বাংলাদেশী ? উনি বললেন- না। আমি ভারতীয় l
দাদু বললেন- অবাক হয়ো না, এরাও বাংলা জানে। বাংলা এখন আমাদের একার ভাষা নয়। বাংলা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা। সুদূর নিউ ইয়র্ক ও আমি বাংলা ভাষায় কথা বলতে দেখে এসেছি। বাংলার পরিধি এখন বিস্তৃত হচ্ছে l
আমার চোখে পড়লো একটি মসজিদ। হঠাৎ আলোর ঝলকানি পেলাম আমি। কি অপরূপ কাজ! কি সুন্দর ! বাহির থেকে দেখতে যেমন না জানি ভেতর কেমন ?
দাদু বললেন, এইটা ভারতের সবচেয়ে বড় মসজিদ।
আমাদের বাংলায় পড়বে না এর পাঠ। আমি তো দেখবোই। একটি সকালের অপেক্ষা মাত্র।
অনেকগুলো গেস্ট হাউস ঘুরে অবশেষে একটি গেস্ট হাউস পেলাম। তেমন মান সম্মত ও না। কিন্তু উপায় নেই।রাত তখন সাড়ে নয় টা। এতো রাতে থাকার মতো কিছু খুঁজে পাওয়া ও দুষ্কর। দাদু বলল, আজ রাত টা জাকারিয়া স্ট্রীট এ থেকে কাল মার্কুইজ স্ট্রীট এ কিংবা মির্যা গালিব স্ট্রীট এ চলে যাবো। ওখানে ভালো থাকার জায়গা মিলবে।
ইউ পি গেস্ট হাউস। খুব সরু সিঁড়ি। তাতে কোনো বিরাম নেই। সোজা সিঁড়ি দিয়ে উঠে কাউন্টার। গেস্ট হাউস এ একটিও জানালা নাই। ছোট লবি, ছোটো বেডরুম। নেই কোনো বারান্দাl খুপরির মতো ঘর গুলোর উচ্চতা অনেক বেশি। কমন টয়লেট। ভেবে অবাক হয়ে যাই , এখানকার লোকগুলো থাকে কেমন করে ?
একজন বিহারি গার্ড আছেন। কিছুক্ষন পর পর এসে টহল দিয়ে যান। গার্ড এর আচার ব্যবহার আমার কাছে ভালো ঠেকলো না। মনে হলো, রবি ঠাকুর এর কাবুলিওয়ালার মতোই খারাপ। খুব সকালে ঘুম ভাঙল আমার।আগের রাতেই অনেক পরিকল্পনা ছিল সকাল সকাল ঘুম না ভাঙলে হয়তো আমার আর এই মসজিদ টিতে যাওয়া হবে না। আমাদের আজ গেস্ট হাউস ছেড়ে দেবার সময়। দাদু ঘুম থেকে উঠলেই আমরা চলে যাবো অন্যত্র। তাই খুব সকালে ঘুম থেকে উঠেই আমি চলে গেলাম মসজিদে। তখন সকাল ছয় টা বাজে। একটা কথা বলে রাখি, মসজিদের আদব যাতে রক্ষা পায় তাই আমি খুব ওযু করে নিলাম।
নাখোদা মসজিদের অলংকরণ শৈলী ও মিনারের দৃশ্যবশেষ
লোক শুন্য অবস্থা। ইউ.পি.গেস্ট হাউসের সরু সিঁড়ি বেয়ে নামলাম। গলির মাথায় একজন বৃদ্ধ লোক বসেছিলেন। উনি আমায় দেখে খুব খুশি হয়ে গেলেন। আমি সামনে যেতেই তিনি আমার সাথে করমর্দন করে হাসি মুখে ভারতীয় ভাষায় বললেন “কলার কে বাহার চারণ ওর” অর্থাৎ বাইরে বের হচ্ছেন বাবু।
আমি তখনো পুরো হিন্দি বুঝি না। শুধু, মাথা নাড়লাম। উনি আমায় হাতের ইশারায় পথ দেখিয়ে দিলেন। এখন পুরো রাস্তা শুনশান,নীরব। গলি থেকে বের হয়ে বড় রাস্তার কিনার ধরে হাটা শুরু করলাম। ঠিক যেন পৃথিবীর মুসাফির মেলা
কে বলবে, এ পথেই যেন রাতের বেলা বসেছিলো হাজারো মুসাফিরের মেলা। মুসাফিরের মেলা এ কারণেই বলছি যে, এখানে শত শত মুসল্লি লোক ছিল। তাদের কেউ কেউ ক্রেতা-বিক্রেতা আবার কেউ বা এখানেই থাকে। বাসা থেকে বের হয়েছে খানিক সময়ের জন্য। বহিরাগতদের সংখ্যাও কম না। জাকারিয়া স্ট্রীট এর রোডটাকে ভালো ভাবে দেখতে চাইলে এখানটিতে চলে আসুন সন্ধ্যার পরে। তারপর দেখুন, পৃথিবীর মুসাফির মেলা। বড্ড বেশি ভালো লাগবে। মনটা জুড়িয়ে যাবে।
মসজিদের ঢুকার আগে আমি আমার জুতো গুলো খুলে একটা ফুলের টবের কাছে রেখে নিলাম। একজন বললো জুতোজোড়া হয়তো নাও থাকতে পারে। আমি কিন্তু কথাটি শুনলাম না। আমি জানতাম যে এটা আল্লাহর ঘর। এতো “ধর্ম-মিষ্ট-ঘ্রান” যে কেউ এ চুরির কাজ করবে না। মসজিদে ছবি তুলতে পারবো কিনা তা নিয়েও কিছুটা দ্বিধান্বিত ছিলাম। পরে দেখলাম দুই জন ইংরেজ পাদ্রী মহিলা মসজিদে প্রবেশ করে ছবি তোলা শুরু করলো। আমার সংশয় ও কেটে গেলো।
আমি তখন এই মসজিদের নাম জানতাম না। হা, নাখোদা মসজিদের কথা বলছি।
রাতের আঁধার ও ভোরের আলোতে শান্তির রেখার সমন্বয়
রাতের অন্ধকারে হাজারো আলোর ঝলকানিতে জ্বল জ্বল করছিলো মসজিদ খানা। লাল আলো, নীল আলো, হলুদ আলো। এতো আলোর ঝলকানি! এতো রূপের সম্মোহন! ঠিক যেনো স্বপ্নময় কল্পনার আবেশ! এতো রং, রূপ, আবেশ যে কারো নজর আটকে রাখবে তা এখানে না আসলে চিন্তাই করা যায় না। রাতের রূপ আর ভোরের রূপ এর মধ্যে একটা গভীর মিল্ আমি খুঁজে পেলাম তা হলো নান্দনিকতা। এত সুন্দর সৃষ্টি রাতের আঁধারেও যেমন হাজার লোকের ভিড়ে, ভোরের শান্তিতেও ।
নাখোদা মসজিদের বহির্ভাগ
কলকাতার জাকারিয়া স্ট্রীট এর নাখোদা মসজিদের অবস্থান
ভারতের প্রধান মসজিদ কলকাতার এই নাখোদা মসজিদ। সেন্ট্রাল কলকাতার বড় বাজার বিভাগের চিৎপুর এ অবস্থিত এই মসজিদ। মহাত্মা গান্ধী রোড থেকে রবীন্দ্র সরণি ধরে দক্ষিণমুখী ৫ মিনিটের পথে জাকারিয়া স্ট্রীটের সংযোগস্থলে রয়েছে এই নাখোদা মসজিদ।
ভৌগোলিক স্থানাঙ্ক ২২°৩৪′৩৫″ উত্তর ৮৮°২১′২১″ পূর্ব
কলকাতার জাকারিয়া স্ট্রীট এর নাখোদা মসজিদ এর ব্যবহার
সুন্নি মুসলিম সম্প্রদায়ের এক সমাহার নাখোদা। প্রায় ১০,০০০ লোক এই মসজিদে একত্রে নামাজ আদায় করে। যে কেউ, যে কোনো ধর্মের লোক ইচ্ছা করলেই এই মসজিদ দেখতে আসতে পারে। তাতে কারো কোন ভ্রূক্ষেপ নেই। অনেক অসহায়, দুস্থ, দুঃখী মুসলিম রাত্রি যাপন করে এই মসজিদ এ। পবিত্র রমজান মাসে লোকেদের জন্য থাকে ইফতারি আর সেহেরির ব্যবস্থা। রমজান মাসের শেষ দশ দিনে মসজিদে বসে ইতিকাফ।
নাখোদা মসজিদের পূর্ববর্তী ও বর্তমান চেহারা: ছবিসূত্রঃ ইন্টারনেট।
সংরক্ষণের পূর্বে
সংরক্ষণের পরে
কলকাতার জাকারিয়া স্ট্রীট এর নাখোদা মসজিদের ইতিহাস
মুসলিম উম্মাহর এক আলোকিত সম্মেলন এই নাখোদা মসজিদ। সিকান্দার এ অবস্থিত মুঘল সম্রাট আকবরের সমাধির অনুকরণে নির্মিত এই মসজিদ। এখানে আগে একটা ছোট মসজিদ ছিল। সেই জায়গাতেই নতুন মসজিদটি তৈরী হয়। আব্দুর রহিম ওসমান নামক একজন ধর্মপ্রাণ ব্যক্তি এই মসজিদ গড়ে তোলেন। তার আদিনিবাস গুজরাটের কচ্ছ অঞ্চল। তিনি সেই অঞ্চলের “কুঁচি মেমন জামাত” নামক একটি দলের নেতৃত্ব দেন। ১৯২৬ সালের ১১ ই সেপ্টেম্বর নাখোদা মসজিদের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয়। তৎকালীন সময় মসজিদটি তৈরি করতে মোট খরচ হয়েছিল ১,৫০০,০০০ টাকা। যার আজকের বাজার মূল্য কয়েকশ’ কোটি রুপি।
নাখোদা মসজিদের ওজুখানা, উপরিভাগের প্লাজা ও উঁচু সিঁড়ির ধাপ।
“খোদার ঘর” এর নাম “নাখোদা” মসজিদ হয় কীভাবে
বড়বাজারের নাখোদা মসজিদ আল্লাহর উপাসনার ঘর। অথচ এই মসজিদের নাম নাখোদা। শুনতে অবাক লাগলেও এটি’ই সত্যি যে এই মসজিদের নামকরণ করা হয়েছে “নাখোদা মসজিদ”।পূর্বে এটিকে “বঢ়ি মসজিদ”বলা হতো।পরবর্তীতে মসজিদটির নামকরণ হয় “নাখোদা।”নাখোদা” শব্দের সমার্থক শব্দ “নাবিক”। এই মসজিদের প্রতিষ্ঠাতা আব্দুর রহিম ওসমান ব্যক্তিজীবনে একজন সামুদ্রিক নাবিক ছিলেন। তার কর্ম এবং আল্লাহর ঘর নির্মাণে তার আগমন কে সম্মান জানিয়ে এই মসজিদের নাম করা হয় “নাখোদা মসজিদ “।
“নাখোদা মসজিদ” নির্মাণে অনুকরণীয় দিক
দূর থেকে দেখলে মনে হবে ঠিক যেন মুঘল সম্রাট আকবর এর সমাধি স্থাপনা এই মসজিদ। মুঘল সম্রাট আকবরের সমাধির আদলে অনেকটা তৈরী এই ধর্মীয় স্থাপনা। এই মসজিদের বহির্ভাগে লাল বেলে পাথরের আস্তরণ করা। যা সিকান্দার এ অবস্থিত আকবর এর সমাধিতেও প্রতীয়মান। আবার এই মসজিদের অন্দরমহল শ্বেতপাথরে নির্মিত যার অনেকটাই দেখতে আগ্রায় অবস্থিত তাজমহলের অন্দরমহলের অনুরূপ। মসজিদের বহির্ভাগের দৈত্যাকার আকার দেখলে মনে হবে “ইতিহাস বিখ্যাত বুলান্দ দরোয়াজার ন্যায় অনুরূপ।
নাখোদা মসজিদের স্থাপত্য বৈশিষ্ট্য
স্থাপত্যকলার এক অনন্য নিদর্শন এই নাখোদা মসজিদ । ইসলামী মুঘল স্থাপত্য রীতিতে তৈরী এই মসজিদ। এটি ইন্দো-শারাসেনিক স্থাপত্যের অংশ ও বলা হয়। প্রায় ১০,০০০ লোকের নামাজ পড়ার সুব্যবস্থা এই মসজিদ এর নামাজ ঘরে। মসজিদটিতে তিনটি গম্বুজ, দুই টি মিনার রয়েছে যেগুলোর উচ্চতা ১৫১ ফুট। এছাড়াও ছোট বড় আরো ২৫ টি উঁচু স্তম্ভ রয়েছে যেগুলোর উচ্চতা ১০০ ফুট থেকে ১১৭ ফুট। সব মিলিয়ে মসজিদে সর্বমোট মিনারের সংখ্যা দাঁড়ায় ২৭। সাদা মার্বেল পাথরের মেঝে, ঝাড়বাতি, বিশাল নমাজ পড়ার স্থান, প্রাচীন কাঠের ঘড়ি,বেলজিয়াম কাচ ও সূক্ষ্ম অলংকরণ এবং শৈল্পিক কল্পনার একটি অনন্যসাধারণ নিদর্শন।
নাখোদা মসজিদের বিভিন্ন অংশ।
নাখোদা মসজিদের প্রধান ফটকটি আগ্রা তে অবস্থিত “ফতেহপুর সিক্রির” বুলন্দ দরওয়াজার আদলে তৈরি। আর এই জন্যই গ্রানাইট পাথর গুলো বিহারের টলিপুর থেকে আনা হয়েছিল। নির্মাতা ম্যাকিনটোস বার্ণ কোম্পানি।নাখোদা মসজিদের বাইরের অংশ লাল বেলেপাথরে তৈরি আর এর অন্দরমহল আগ্রার তাজমহলের আদলে তৈরি যা শ্বেত পাথরে তৈরী। মসজিদের ভিতরকার নিখুঁত অলংকরণ আর শৈল্পিক চিত্তাকর্ষক এক চমৎকার আবহ তৈরী করে।
নাখোদা মসজিদের মিনারের সচিত্র।
নাখোদা মসজিদের বিভিন্ন অংশ।
- নামাজের স্থান (পুরুষ)
- নামাজের স্থান (নারী)
- নামাজের স্থান (শিশু)
- বারান্দা (ছাদ সহ
- বারান্দা (ছাদ বিহীন)
- প্রধান ত্বোরণ দ্বার
- হুজুরের থাকার ঘর
- মোতয়ালী ঘর
- শৌচাগার (পুরুষ)
- শৌচাগার (নারী)
- শিরনি রান্নার স্থান
- সংরক্ষণাগার
- উন্মুক্ত প্লাজা
- ওজুখানা (কূপ ঘর)
- ওজুখানা সমেত সিঁড়ি
- ওযুখানার ছাদ
- গম্বুজ
- মিহিরাব
- মিম্বার
- মিনার
প্রধান ত্বোরণ দ্বার
আগ্রার ফতেপুর সিক্রিতে অবস্থিত দৃষ্টি নন্দন স্থাপনা “বুলান্দ দরওয়াজা ” এর ন্যায় এই নাখোদা মসজিদের প্রধান ত্বোরণ দ্বার।প্রধান ত্বোরণ দ্বার চতুর্থ তলা বিশিষ্ট। এর উপরিভাগে দুই রুম রয়েছে। নিচের দুই তলা জুড়ে প্রধান ফটক। মূল প্রবেশ পথ টি একটি বিশাল আকৃতির খিলান বিশিষ্ট। এই খিলানের মধ্যে বড় আকৃতির লৌহ দরজা রয়েছে। খিলানের উপরে নয়টি আয়তাকার প্যানেল রয়েছে। প্রতি তিন সারি প্যানেল এর উপরে আরো তিন সারি প্যানেল। এইভাবে করে নয় সারি প্যানেল রয়েছে। ছয় সারি প্যানেল এর উপরে আরবি লিখা উৎকীর্ণ করা হয়েছে। এক খিলান বিশেষিত মূল দরাজার উপরে ছোট ছোট মিনার ও তার উপরে শৃঙ্ঘ রয়েছে। তাছাড়া এই দরজায় ছোট ছোট ফুলের নকশা ও মারলন রয়েছে। মূল দরজার ভিতরের ভাগে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের সময়সীমা যুক্ত ঘড়ি সাঁটানো রয়েছে। ভিতরের প্লাজার সাথে সংযুক্ত প্রধান ত্বোরণ দ্বার।
প্রধান ত্বোরণদ্বারের বহির্ভাগ ও অন্তর্ভাগ
নাখোদা মসজিদের ওজুখানা
নাখোদা মসজিদের সবচেয়ে দৃষ্টিনন্দন ব্যাপার হলো এই মসজিদের ওজুখানা। ওযুখানার স্থানটি মসজিদ প্রবেশের পথেই। ওযুখানাটি এক তলা একটি ভবন। প্লাজা থেকে আটটি সুদৃশ্য ধাপ বিশিষ্ট।
নাখোদা মসজিদের ওজুখানা সচিত্র
ওযুখানার অভ্যন্তরে ওযু করার জন্যে কূপের ব্যবস্থা রয়েছে।যার চারিপার্শ্বে মুসল্লীদের বসে ওযু করার জন্যে উঁচু ধাপ রয়েছে। কূপের পানিতে রং বেরঙের বহু মাছ রয়েছে। মুসল্লীরা ওযু করার সময়ে এই রঙ্গিন মাছের খেলা করে।কূপের দেয়ালের এক পার্শ্বে চতুরখিলান দেখা যায়। অপর পার্শ্বে দুইটা খিলান দেখা যায়। কূপের উপরিভাগ অর্থাৎ ছাদের উপরিভাগ উন্মুক্ত পরিসর। এই উন্মুক্ত স্থানের সাথে খোলা আকাশের একটি সম্পর্ক রয়েছে। ওজুখানা থেকে উন্মুক্ত আকাশ দেখা যায়। বৃষ্টির দিনে বৃষ্টির পানি সরাসরি এই কূপে প্রবেশ করতে পারে। তখন এক অন্য রকম আবহ সৃষ্ট হয়। প্লাজা থেকে কূপ হয়ে উপরিভাগে উঠবার জন্যে একটি টানা সিঁড়ি রয়েছে। এই সিঁড়ি দিয়ে সোজা উপরে উঠলে ছাদের অংশ বিভিন্ন উৎসব বা পর্বের সময় ব্যবহার করা যায়।
নাখোদা মসজিদের অভ্যন্তরভাগ।
“উৎসব” বা “পরবের” সময় কলকাতার নাখোদা মসজিদটিকে চমৎকার ভাবে সুসজ্জিত করা হয়। যে কেউ “উৎসব” বা “পরবের” সময় ঘুরতে গেলে বেশি আনন্দ পাবে। প্রতিবছর ঈদের সময় নতুন রূপে সাজানো হয় এই মসজিদ টিকে। দুই ঈদে মসজিদকে কেন্দ্র করে ১ লক্ষ ২৫ হাজারের বেশী মানুষের জামাত হয়। শুধু ঈদের দিন নয়, প্রতি জুম্মাবারে ২৫,০০০-৩০,০০০ মানুষ এখানে একত্রে জামাতের সাথে নামাজ আদায় করে থাকেন।
উৎসবে আয়োজনে নাখোদার সরগরম
আশুরা বা মহররম এর সময় জমকালো উৎসবে মেতে উঠে নাখোদা মসজিদ। এই মসজিদ থেকে বড় তাজিয়া মিছিল বের হয়। মিছিলের সাথে আরো চলে লাঠি খেলা ও অস্ত্র খেলার প্রদর্শনী। নাখোদা ঘিরে থাকে নানা রকম সুশোভিত দোকানপাট। নানা রকম বর্ণিল কেনাকাটার মাঝ দিয়ে আরেকটি মিষ্টি সাধ গ্রহণ করতে হয়। তা হলো “ফিরনি”।
ধর্মীয় ভাব গাম্ভীর্যের এই অপরূপ স্মারক দেখে আমি বেরিয়ে এলাম। অনেক ছবিও তুললাম। জুতা জোড়া কিন্তু ঠিক আগের জায়গাতেই ছিল।
জাকারিয়া স্ট্রীট বনাম নাখোদা মসজিদ
জাকারিয়া স্ট্রীটের জনপ্রিয়তা হওয়ার পেছনে এই নাখোদা মসজিদ গুরুত্তপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। মসজিদটি যেখানে রয়েছে তাকে কেন্দ্র করে এমন কিছু জিনিস পাওয়া যায়, যেগুলো কলকাতার অন্যান্য স্থানে পাওয়া প্রায় অসম্ভব। কলকাতার এই স্থানটিতে সবচেয়ে ভালো আতর,মিষ্টি সুগন্ধি পানি পাওয়া যায়। আরো পাওয়া যায় মিষ্টি জর্দা, কিশমিশ, খেজুর প্রভৃতি । বাংলাদেশ, পাকিস্তান, তুরস্ক থেকে আসা নকশী করা নামাজি টুপির বড়ো মার্কেট এখানেই।দেশি-বিদেশিপাঞ্জাবি, কুর্তা, পাগড়ি, শেরওয়ানী,জায়নামাজ সব পাওয়া যায় এখানে।
সকল ধর্মের লোকের মিলনমেলা ও সম্প্রীতি কোলকাতার নাখোদা মসজিদ পরিদর্শনে কোন বিধি-নিষেধ নেই। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ ছাড়াও যে কেউ এই মসজিদে ঘুরে দেখবার জন্যেও প্রবেশ করতে পারে। প্রতিদিন স্থানীয় লোকজন ছাড়াও বহু বিদেশী ও অন্য ধর্মের লোকেদের আগমন ও ঘটে এই মসজিদে। নেই কোন টিকেট এর ব্যবস্থা। রমজান মাসে মুসল্লী ও ধর্মপ্রান লোকেদের জন্যে থাকে নানা আয়োজন ও ইতিকাফের ব্যবস্থা। ভোর ০৬.০০ টা থেকে রাত ০৮.০০ টা পর্যন্ত যখন খুশি যে কেউ এই মসজিদে ঘুরে আসতে পারেন।
মসজিদের ভিতরে ছবি তুললেও কারো আপত্তি নেই। তবে মসজিদ আল্লাহর ঘর। কায়মনোবাক্যে, পবিত্র চিত্তে- ওযু সহকারে মসজিদে প্রবেশ করা উচিত।
মসজিদের অভ্যন্তরে বিভিন্ন অংশে আগত আলোর পরিমান।
একটি মিথ
সব ঐতিহাসিক স্থাপনা নিয়ে কমবেশি মিথ প্রচলিত রয়েছে। তার মধ্যে নাখোদা মসজিদ ব্যতিক্রম নয়। ভারতীয়দের প্রজন্মবাহিত গৌরব এই নাখোদা মসজিদ বলে অনেকেই বিশ্বাস করেন। পবিত্র রমজান মাসে যে ঈদের চাঁদ মসজিদের উপরে নেমে আসে সেই চাঁদ বিশেষ কোন সম্প্রদায় বা ধর্মের নয় বরঞ্চ সেই চাঁদ ভারত উপমহাদেশের সকল লোকের, সকল মানুষের।
নাখোদা মসজিদের বিভিন্ন অংশ।
নাখোদা মসজিদের বিভিন্ন অংশ।
উপসংহার
প্রতিদিন মসজিদকে কেন্দ্র করে নিজের অজান্তেই প্রদক্ষিণ করে চলেছে হাজারে হাজারে ক্রেতা-বিক্রেতা থেকে পর্যটকের দল। আর এটাই বাস্তব। যাকে কেন্দ্র করে এতো আয়োজন, সে সাজবে না তাই কি হয়! ইতিহাসের পাতার তাই আর এক অধ্যায় সংযুক্ত হল যার নাম নাখোদা মসজিদ।
ডকুমেন্টেশন সহায়তায় – আফনান প্রান্ত, স্থাপত্য বিভাগ, সাউথ ইস্ট বিশ্ববিদ্যালয়।
আগে জানলে ঘুরে আসা যেত। এরপর গেলে যেতে হবে। ধন্যবাদ তথ্যবহুল লেখার জন্য।