ঢাকা বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা ড্যাপ ২০২২-২০৩৫ এবং জনঘনত্ব ব্যবস্থাপনা
মোহাম্মদ রাসেল কবির, যুগ্ম-সম্পাদক, বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব প্ল্যানার্স (বি.আই.পি)
ড্যাপ ২০২২-২০৩৫ এবং জনঘনত্ব ব্যবস্থাপনা। একটা জনপদ শহর হবে না গ্রাম তার মূল পার্থক্যটাই হলো জনসংখ্যার আকার ও জনঘনত্ব। ছোট, মাঝারি, ও বড় শহর থেকে শুরু করে মেট্রো সিটি ও মেগা সিটির ক্ষেত্রেও পার্থক্য গড়ে দেয় জনসংখ্যার আকার ও জনঘনত্ব। জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে শহরের আকার বড় হয়, পেশার বৈচিত্র থাকে, অর্থনৈতিক সক্ষমতা বাড়ে, পুঁজির সন্নিবেশ হতে থাকে, চক্রাকারে যা আবার শহরকে আরও বড় হতে সাহায্য করে। স্থানীয় সরকার (পৌরসভা) আইন, ২০০৯ এ বলা আছে কোন এলাকাকে পৌরসভা ঘোষণার ক্ষেত্রে নূন্যতম মোট জনসংখ্যা ৫০,০০০ জন এবং জনসংখ্যার ঘনত্ব প্রতি বর্গ কিলোমিটারে গড়ে ১,৫০০ জন মর্মে নিশ্চিত হতে হবে। অন্যদিকে স্থানীয় সরকার (সিটি কর্পোরেশন) আইন, ২০০৯ অনুসারে সিটি কর্পোরেশন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রেও বিদ্যমান পৌর এলাকার জনসংখ্যা এবং জনসংখ্যার ঘনত্বকে যথাযথ বিবেচনায় রাখতে হবে। ফলে, দেশের প্রচলিত আইন অনুসারেও নগর প্রতিষ্ঠা থেকে শুরু করে নগর পরিকল্পনা, উন্নয়ন, ও ব্যবস্থাপনার এক্কেবারে মূলে রয়েছে জনঘনত্বর বিষয়টি।
খুব সহজে বোঝার জন্য একটা উদাহরণ দেই। যদি ১০০০ বর্গফিটের এক বাসায় পরিবারের লোক থাকেন ৫ জন এবং গৃহকর্মী থাকেন ১ জন, কিছুদিন পরে আত্মীয়-স্বজন আসলো ২ জন, গ্রাম থেকে দূরের পরিচিত লোক আসলো আরও ২ জন, মোট ১০ জন। এখন এই ১০০০ বর্গফিটের বাসায় নিয়মিতভাবে ১০ জন কি থাকা সম্ভব? শুধু ঘুমানোর জায়গা ছাড়াও রান্না-বান্না, খাওয়া-দাওয়া, গোসল, প্রাকৃতিক কর্ম ইত্যাদির জন্য পর্যাপ্ত জায়গা প্রয়োজন, যা ওই ১০০০ বর্গফিটের বাসা ১০ জন লোককে দিতে পারবে না। ফলে বোঝাই যাচ্ছে, ১০০০ বর্গফিটের একটা বাসার ধারণ ক্ষমতা (Carrying Capacity) এরও একটা সীমা আছে, তার বেশি সে নিতে পারবে না। আর “চিৎ-কাইত” হোটেলের মতোন না থেকে একটু ভালোভাবে থাকতে চাইলে সেই ধারণ ক্ষমতার সীমার নিচে থাকতে হবে। এটা তো গেল নগর পরিকল্পনার ‘শিশু পাঠ’।
এখন ‘সহজ পাঠ’ এ আসি। পরিকল্পিত কোন পাড়া বা মহল্লার নকশায় ২০/২৫/৩০/৪০ ইত্যাদি ফিটের রাস্তা সহ অনান্য সকল নাগরিক সুযোগ সুবিধা প্রদান করা হয়ে থাকে। এই ২০/২৫/৩০/৪০ ফিটের রাস্তার সুবিধা কি “যেমন ইচ্ছা লেখার আমার কবিতার খাতা’র মতোন করে নির্ধারন করা হয়? নাকি এর পিছনে বেশ কিছু সমীক্ষা ও বৈজ্ঞানিক হিসাব কষা থাকে? বাস্তবে, পরিকল্পিত ওই এলাকার জন্য প্রথমে একটি নির্দিষ্ট ‘অনুমিত জনসংখ্যা (Estimated or Design Population)’ ও ‘জনঘনত্ব’ নির্ধারণ করার পর সেই অনুযায়ী সেখানে প্লট/ফ্লাট এর পরিমান এবং পরিমাপ নির্ধারণ করে রাস্তাসহ অন্যান্য নাগরিক সুবিধাধি প্রদান করা হয়। ধরা যাক, একরপ্রতি জনসংখ্যা নির্ধারণ করা হলো ৩৫০ জন, তাহলে ১০ একরের একটা এলাকার জন্য অনুমিত জনসংখ্যা হবে ৩৫০০ জন। এখন যদি সেখানে অনান্য নাগরিক সুবিধা প্রদান করার পর ৩ কাঠার সর্বোচ্চ ১২০টা প্লটের সুযোগ রাখা হয় এবং প্রতিটা প্লটে যদি একতলা বাড়ি সাপেক্ষে ১০ জন করে থাকতে পারে তবে মোট জনসংখ্যা হবে ১২০০ জন। যদি সবগুলো প্লট দোতালা হয় তবে মোট জনসংখ্যা হবে ২৪০০, তিনতলা হলে ৩৬০০, চারতলা হলে ৪৮০০, পাঁচতলা হলে ৬০০০, এবং ছয়তলা হলে ৭২০০ জন। অর্থাৎ তিনতলাতেই ওই এলাকার অনুমিত জনসংখ্যা পাড় হয়ে যাচ্ছে এবং ছয়তালাতেই তা দ্বিগুণ এর বেশি হয়ে যাচ্ছে, তথাপি রাস্তাসহ অন্যান্য সুবিধা কিন্তু দ্বিগুণ হচ্ছে না। ফলে, বিদ্যমান চলাচলের জায়গা, এবং পানি, বিদ্যুৎ, গ্যাস, নর্দমা, সুয়ারেজ ইত্যাদি পরিষেবা সহ পার্ক, খেলার মাঠ, ও অনান্য নাগরিক সুবিধাধি সংকুচিত হয়ে পড়বে। গণহারে ছয়তলা বানাতে দিলে বিদ্যমান অবকাঠামো ও পরিষেবাগুলোর উপর দ্বিগুন চাপ পড়বে, এর চেয়ে বেশি বানাতে দিলে কি হবে তা বলাই বাহুল্য।
অন্যদিকে, অপরিকল্পিত এলাকায় লোকজন শুধু নিকটবর্তী সরকারি রাস্তা থেকে নিজ নিজ জমিতে কোনমতে প্রবেশ করার জায়গা সহ জমি ক্রয় করে এবং পরবর্তীতে সেখানে একতলা, একাধিকতল, ও বহুতল বাড়ি বানায়। পরবর্তিতে, এসব এলাকায় নাগরিক সেবা ও পরিষেবা তো দূরে থাক, পর্যাপ্ত পরিমাণ ও নির্দিষ্ট প্রস্থের রাস্তা দেওয়ারও জায়গা থাকে না। ফলে, সেখানেও জনসংখ্যা ও জনঘনত্ব নিয়ন্ত্রণ করাটা আরও বেশি জরুরী হয়ে পরে। জনঘনত্ব নিয়ন্ত্রণ এর ক্ষেত্রে Floor Area Ratio বা FAR একটা উপকরণ (Tools) হিসাবে ব্যবহৃত হয়। FAR এর সূচক কম-বেশি করার মাধ্যমে কোন এলাকার ভবনের উচ্চতা ও আকার নিয়ন্ত্রণ করা যায়। এর ফলে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ দুইভাবেই জনঘনত্ব নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। যেমন, FAR এর সূচক যদি ১ হয়, তবে ভবনের উচ্চতা বাড়ালেও ভবনের মোট ব্যবহার উপযোগী মেঝের আকার একই থাকবে, ফলে উচ্চতা বাড়লেও লোকসংখ্যা বাড়বে না। সূচক যদি ১ এর বেশী হয়, তবে ভবনের উচ্চতা বাড়ালে ভবনে মোট ব্যবহার উপযোগী মেঝের আকার বাড়বে, ফলে একই প্লটে বসবাসযোগ্য লোকের সংখ্যা আগের থেকে বাড়বে। FAR এর সূচক আরও বেশি হলে তা আরও বাড়বে। আমরা সবাই জানি যে, দোতালা, তিনতলা, চারতলা, বা বহুতলা বানানোর মাধ্যমে বাড়তি জায়গা (Physical space) তৈরি করা হয় অতিরিক্ত লোককে ঠাই দেওয়ার জন্য। এই অতিরিক্ত লোককে জায়গা দেওয়াটা আপাতদৃষ্টিতে মানবিক মনে হতে পারে, তবে ইতিমধ্যেই সেই এলাকায় বসবাসকারী লোকদের জন্য বিষয়টা অত্যন্ত অমানবিক, সাথে যে অতিরিক্ত লোক যোগ হচ্ছে তাদের জন্যও। কারণ, এই অতিরিক্ত লোকজন শুধু ভবনের সেই বাড়তি Physical space এই থাকে না, তারা ভবনটি যেই পাড়া বা মহল্লায় অবস্থিত, সেখানেও ভাগ বসায়। তথাপি, সেখানে রাস্তা-ঘাট, নালা-নর্দমা সহ অনান্য যে গণরিসর, যেমন, পার্ক, খেলার মাঠ, ইত্যাদি রয়েছে সেগুলোকে কিন্তু আর একাধিক বা বহুতল করা যাচ্ছে না। অধিকিন্তু, এই অতিরিক্ত লোক বিদ্যমান অবস্থার তুলনায় অতিরিক্ত ট্রিপ জেনারেট করবে, অতিরিক্ত পানি ব্যবহার করবে, অতিরিক্ত ময়লা-পানি ও আবর্জনা উৎপন্ন করবে, এমনকি অতিরিক্ত কার্বন-ডাই-অক্সাইড ও তাপ উৎপন্ন করবে। অতিরিক্ত জনসংখ্যা বর্তমান অবকাঠামোর উপর চাপ সৃষ্টি করবে। ফলে, যেকোন বিবেচনায় জনসংখ্যা ও জনঘনত্ব নিয়ন্ত্রণ করাটা অত্যন্ত জরুরী। FAR এর মাধ্যমে ঠিক সেই কাজটাই করা হয়ে থাকে। FAR এর সূচক কখনো প্লটের আকার অনুযায়ী নির্ধারন করা হতে পারে, কখনো সংলগ্ন রাস্তা অনুসারে, কখনো এলাকা ভেদে নির্ধারিত হতে পারে, অথবা একাধিক প্রক্রিয়ায় বা অন্য কোন উপায়ে। যেহেতু FAR একটা উপকরণ হিসাবে ব্যবহৃত হয়, ফলে FAR কিভাবে নির্ধারন করা হবে তা আসলে নির্ভর করবে ওই এলাকার বর্তমান জনঘনত্ব এবং বিদ্যমান ভৌত অবকাঠামো ও নাগরিক সুবিধার উপর। অর্থাৎ বিদ্যমান ভৌত অবকাঠামো ও নাগরিক সুবিধাধি বাড়তি জনসংখ্যার কতটুকু চাপ নিতে পারবে এবং ভবিষ্যতে এসকল অবকাঠামো ও সুবিধার কতটুকু সম্প্রসারনের সুযোগ রয়েছে তা বিবেচনায় নিয়ে FAR এর সূচক নির্ধারন করা হয়।
এখন প্রশ্ন হলো, সবগুলা প্লটেই কি একসাথে একাধিকতলা বিশিষ্ট ভবন নির্মিত হয়? উত্তর খুব সোজা, একসাথে না হলেও কোন প্লটে যদি কেউ ইতিমধ্যে ৬ তলা বাড়ি বানিয়ে ফেলে তাহলে সে অন্য আরেকজনের কোটা পূর্ণ করে ফেলেছে। সম্পূরক প্রশ্ন হলো, এর ফলে পরবর্তিতে যে বাড়ি বানাবে বা বানাতে চাচ্ছে তাকে বঞ্চিত করা হবে কিনা অথবা সে ক্ষতিগ্রস্ত হবে কিনা? এ প্রশ্নের উত্তরের মূলে থাকবে সরকারের ‘আবাসন নীতি (Housing Policy)’। অর্থাৎ, পরিকল্পিত এলাকায় সরকার যখন কাউকে প্লট দেয়, তখন তাকে আসলে ইজারা (Lease) দেয় সেখানে বসবাস করার জন্য। সেই প্লটে বাড়ি বানিয়ে বা প্লট কেনা-বেচা করে ব্যবসা বা আয়-রোজগার বাড়ানোর জন্য না। তথাপি, সরকার চাইলে কিছু সম্পূরক নীতির দ্বারা বেসরকারি খাতের মাধ্যমে ক্রমবর্ধমান আবাসন চাহিদা পূরণের জন্য সহায়তা দিতে পারে। যেমন, সহজ শর্তে হাউজ বিল্ডিং লোন দিয়ে ভবন বানানোর সুযোগ সৃষ্টি করা। ঢাকার ক্ষেত্রে প্লট মালিকদের অনেকেই এই সুযোগ নিয়ে একাধিক ও বহুতল ভবন বানিয়ে শহরের আবাসন চাহিদা পূরণ করেছে ঠিকই, কিন্তু সঠিক নিয়ন্ত্রণের অভাবে এই নীতির কারণে আমাদের নিন্ম-মধ্য বিত্ত থেকে শুরু করে উচ্চ-বিত্ত সবাই এটাকে ব্যবসা ও পেনসন স্কিম বানিয়ে ফেলেছে। তো প্লটের মালিক যারা পরে একাধিকতলা বিশিষ্ট ভবন বানাতে চান, তাদের নাখোস হবার কারণ সম্ভবত এটাই যে, সরকার তাদেরকে এই লোভনীয় ব্যবসা থেকে দূরে সরিয়ে রাখছে। তাদের ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ার সঙ্গত কোন কারণ নেই, যেহেতু সরকার তো আর তার কাছ থেকে প্লট কেড়ে নিচ্ছে না বা তাকে একতলা বাড়ি বানাতেও নিষধ করছে না। তথাপি, অনেক দেশে সরকারে কাছ থেকে প্লট পেয়ে নির্ধারিত সময়ে বাড়ি না বানিয়ে ফেলে রেখে সরকার নির্ধারিত আবাসন চাহিদা পূরণ না করার কারণে প্লট ফেরত নেওয়ারও অনেক নজির আছে। তবে এই ক্ষেত্রে, উন্নয়ন নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষকেও দূরদর্শি হতে হয় সবাইকে সমানভাবে সুযোগ দেওয়ার জন্য। কিন্তু আমাদের মতোন আর্থসামাজিক বৈষম্যযুক্ত ও দ্রুত বর্ধনশীল নগরীর বেলায় কিছু ক্ষেত্রে উন্নয়ন নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষেরও সীমাবদ্ধতা থাকে একই সাথে ক্রমবর্ধমান আবাসন চাহিদা পূরণের পাশাপাশি সবাইকে সমভাবে সুযোগ প্রদান করার, যেহেতু কে কবে কয়তলা বাড়ি বানাবে সেটা প্রক্ষেপ করাটাও মুশকিল। ফলে, বিদ্যমান আবাসন চাহিদা পূরণ করার জন্য যে আগে বাড়ি বানাতে চাচ্ছে, তাকে সে সুযোগটা দেওয়া হয়, কিন্তু তার মানে এই না যে, ২০/২৫ বছর পরেও অন্যদেরকে একই সুযোগ দিতে হবে। কারণ ততদিনে প্রেক্ষাপট পালটে গেছে। তবে, প্লট মালিকের নিজের থাকার জন্য যতটুকু ভবন বানানো দরকার, তাকে সেই সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা যাবে না।
এইবার নগর পরিকল্পনার ‘উচ্চতর ও জটিল পাঠ’ এ যাই। উপরের উদাহরণগুলো একটা পাড়া বা মহল্লা বিবেচনায় দেওয়া হয়েছে। এখন পুরা শহরের ক্ষেত্রে তাহলে কি ঘটবে? রাস্তাসহ অন্যান্য নাগরিক পরিষেবাগুলা পাড়া বা মহল্লা পর্যায়ে প্রদান করা হলেও এগুলা মূলত, প্রাথমিক, দ্বিতীয়, এবং তৃতীয়- এই তিন স্তরে অনুক্রমিকভাবে সংযুক্ত থেকে পুরো শহর জুড়ে একটা অন্তর্জাল তৈরি করে। এছাড়াও, বেশ কিছু নাগরিক অবকাঠামো থাকে শহর পর্যায়ে, যেমন হাসপাতাল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, বড় উদ্যান, স্টেডিয়াম, যাদুঘর, সম্মেলন কেন্দ্র ইত্যাদি। এক্কেবারে পাড়া বা মহল্লায় নাগরিক পরিষেবাগুলা হয় তৃতীয় স্তরের, এগুলো সংযুক্ত থাকে দ্বিতীয় স্তরের সাথে, এবং দ্বিতীয় স্তর সংযুক্ত থাকে প্রাথমিক স্তরের সাথে যা শহরের একপ্রান্ত থেকে আরেকপ্রান্তে বিস্তৃত থাকে। ফলে, তৃতীয় স্তরের বাড়তি চাপের ঢেউ কিন্তু প্রাথমিক স্তরেও এসে পড়ে। সহজ ভাষায় এই জটিল জিনিস বোঝার চেষ্টা করি রাস্তার উদাহরণ দিয়ে। যদি তৃতীয় স্তরের রাস্তাগুলার ধারণ ক্ষমতা ১ হয় এবং ৪টা তৃতীয় স্তরের রাস্তা একটা দ্বিতীয় স্তরের রাস্তার সাথে যুক্ত থাকে, তবে সেই দ্বিতীয় স্তরের রাস্তার ধারণ ক্ষমতা হতে হবে নূন্যতম ৪। আবার এইরকম ২০ টা দ্বিতীয় স্তরের রাস্তা যদি একটা প্রাথমিক স্তরের রাস্তার সাথে যুক্ত থাকে তবে সেই প্রাথমিক স্তরের রাস্তার ধারণ ক্ষমতা হতে হবে নূন্যতম ৮০। এখন ধরি, পাড়া বা মহল্লা পর্যায়ে জনসংখ্যা বাড়ার ফলে তৃতীয় স্তরের রাস্তায় ট্রাফিক হলো ৩, তাহলে দ্বিতীয় স্তরের রাস্তায় ট্রাফিক হবে ১২, আর প্রাথমিক স্তরের রাস্তায় হবে ২৪০। গানিতিকভাবে সব রাস্তায় ট্রাফিক তিনগুন বাড়লেও সংখ্যাগতভাবে ৩ আর ১ এর পার্থক্য ২, আবার ১২ আর ৪ এর পার্থক্য ৮, এবং ২৪০ আর ৮০ এর পার্থক্য ১৬০। সহজভাবে বললেও ব্যাপারটা অত্যন্ত জটিল। ঢাকায় প্রতিদিন আমরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা যে দুঃসহ ট্রাফিক জ্যাম ভোগ করে থাকি, তার মূলে রয়েছে এই সরল অংকের জটিল হিসাব। অনান্য নাগরিক পরিষেবার ক্ষেত্রেও ঠিক একই অবস্থা। ড্রেনের লাইন, পানির লাইন এর ধারন বা বহন ক্ষমতা (Capacity) বাড়াতে হলে রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি করে আরও ট্রাফিক জ্যাম লাগাতে হয়। অন্যদিকে, ঢাকায় ভূ-গর্ভস্থ্য পানির স্তর আশংকাজনকভাবে কমছে নিয়মিত ব্যবহার ও ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটাতে গিয়ে। পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া স্বরূপ শহর ধীরে ধীরে ডেবে যাচ্ছে। আবার অতিরিক্ত জনসংখ্যার কারণে বাতাসে কার্বন-ডাই-অক্সাইড এর পরিমান বাড়ছে, ফলসরূপ শহরের তাপমাত্রা বাড়ছে। সর্বোপরি, শহর পর্যায়ের নাগরিক সেবা গুলোকে বিস্তৃত করার বা নতুন নতুন অবকাঠামো নির্মাণের পর্যাপ্ত জায়গা নেই। যে কোন বিচারেই ঢাকা এর বাসযোগ্যতা হারিয়েছে। তাই, নাগরিক সেবা, যোগাযোগ, সামাজিক, জনস্বাস্থ্য, পরিবেশ ইত্যাদি বিবেচনায় ঢাকাকে বাঁচাতে হলে এর জনঘনত্ব নিয়ন্ত্রণ করা ছাড়া আর কোন বিকল্প নাই।
ঢাকা বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা ড্যাপ ২০২২-২০৩৫
-তে জনঘনত্ব নিয়ন্ত্রণের জন্য এলাকাভিত্তিক FAR এর বিধান রাখা হয়েছে। শহরের উচ্চবিত্তের এলাকাগুলোতে FAR এর সূচক বেশি রাখা হয়েছে সেখানের প্লটের আকার, সংলগ্ন রাস্তা, এবং বিদ্যমান ভৌত অবকাঠামো ও নাগরিক সুবিধার উপর। অন্যদিকে, একই বিষয় বিবেচনায় মধ্যবিত্তের এলাকাগুলো FAR এর সূচক কম পেয়েছে। এছাড়াও, সব এলাকাতেই NR FAR (Non Restricted FAR) বা Unlimited Height নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। তবে, এ পরিকল্পনায় প্রস্তাবিত FAR শুধু আবাসিক ভবনের জন্য প্রযোজ্য, অন্যান্য ক্ষেত্রে ভবনের FAR ঢাকা মহানগর ইমারত (নির্মাণ, উন্নয়ন, সংরক্ষণ, অপসারণ) বিধিমালা -২০০৮ অথবা পরবর্তী সংশোধনী অনুযায়ী প্রযোজ্য হবে।
ঢাকায় যতগুলো ভবন আছে, তার বেশিরভাগ ফ্লাটে লোকজন ভাড়ায় থাকে। তাই, FAR এর সূচক বাড়ানো বা কমানোর সাথে আবাসন শঙ্কট শুরু হওয়ার কোন সংযোগ নেই, বরং FAR এর সূচক কমানোর ফলে নাগরিক সুবিধার ক্রমবর্ধমান চাহিদা মোকাবিলা করার এবং উন্নয়ন নিয়ন্ত্রণ এর মাধ্যমে নাগরিক সেবা বিকেন্দ্রীকরণের পর্যাপ্ত সুযোগ ও সময় পাওয়া যাবে। এছাড়াও, সরকার যদি সত্যিই ঢাকার নাগরিকদের সবার জন্য নিজস্ব আবাসন এর ব্যবস্থা করতে চায়, তাহলে উপযুক্ত নীতিমালা তৈরি করে বর্তমানে শহরে যেসকল ফ্লাট ভাড়া দেওয়া হচ্ছে, সেগুলো প্লট বা ফ্লাটহীন লোকজনের কাছে বিক্রির মাধ্যমে এ চাহিদা পূরণ করার উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারে।
উনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে স্থাপত্য পেশার হাত ধরে আধুনিক নগর পরিকল্পনার শুরুটা হলেও, নিয়ত পরিবর্তনশীল ও জটিল মাত্রার কারণে ‘নগর পরিকল্পনা’ বহু ডিসিপ্লিনের নানাবিধ তত্ত্ব দ্বারা পরিশালিত ও সমৃদ্ধ হয়ে কোন স্থিত বিষয় হিসাবে না থেকে সতন্ত্র পেশা হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে। ফলে, নগর পরিকল্পনার সামগ্রিকতা বুঝতে হলে ‘শিশু পাঠ’ থেকে শুরু তো অবশ্যই করতে হবে, কিন্তু যথাযথ পড়াশোনা, নিয়মিত চর্চা ও গবেষণার পর তবেই এর উচ্চতর পাঠের মর্ম বোঝা যাবে। আর তা নাহলে ‘শিশু পাঠেই’ আটকে থেকে আবার সেই অন্ধের হাতি দর্শনের মতোন খাম্বা, কুলা বা দেয়াল হাতরে বেরাতে হবে।
——————————————————————
Related