গ্রামীণ জনপদের ঘর

গ্রামীণ জনপদের ঘর বাড়ি_ঘর-১১

গ্রামীণ জনপদের ঘর বাড়ি_ঘর-১১

[লেখকঃ স্থপতি খান মোঃ মাহফুজুল হক জগলুল, প্রধান স্থপতি, ইন্টারডেক সিস্টেমস, ঢাকা]

গ্রামীণ জনপদের ঘর – আগুন

গ্রামীণ জনপদের ঘর – মনজুরুল, সিরাজুল আর বাদলের অগ্নিদগ্ধ কাঠের ঘর:
ওস্তা পাড়া, কলাখালি ইউনিয়ন, পিরোজপুর


নাম মনজুরুল, বয়স ৩২/৩৪। নিরক্ষর মনজুরুলের বাবা নেই শধু আছে ২ ভাই, বাবার মৃত্যুর পর মা আবার বিয়ে করেছে ( স্থানীয় ভাষায় বলে, বিয়া বইছে) , মা নতুন সংসার নিয়ে ব্যস্ত ওদের সাথে যোগাযোগ কম। ছোট ভাই বাদল ওর সাথে থাকে তবে বেশির ভাগ সময়ই ও থাকে জাহাজে , সে বৈধ-অবৈধ ভাবে নদী থেকে বালি তোলা একটা ছোট ড্রেজিং জাহাজের হেড কামলা। দুই নিরক্ষর ভাইদের মাঝে বড় ভাই কেমন করে যেন জাতীয় বিশ্ববিদ্যাল থেকে ডিগ্রি পাস করে ফেলেছে। ওর নাম সিরাজুল, গ্রামের মানুষেরা ডাকে ‘ সেরু ‘ । গ্রামের মানুষের নাম বিকৃত করে ডাকার একটা সর্বসম্মত অভ্যাস আছে…… বেলায়েত নাম হলে তাকে ডাকা হবে
‘ বেলা ‘, জলিল সরদারকে ডাকা হবে ‘ জলু সরদার ‘ আর জলিল যদি খুব গরীব শ্রেণীর হয় তবে তাকে ডাকা হবে ‘ জইল্যা ‘, হেমায়েত কাজী নাম হলে তাকে ডাকা হবে ‘হেমা কাজি ‘ একই ফরমুলায় আনোয়ার মোল্লা হয়ে যায় ‘ আনু মোল্লা ‘ আর সৈয়দ আলি যেহেতু খুব গরীব তাই সে হয়ে যায় শুধু ‘ সৈয়া ‘।

বাদা জালে কালিগঙ্গায় মাছ ধরাই মনজুরুলের একমাত্র পেশা বলা যায়। নদীতে একটা বাদা জাল পাতার পর ৩ কিলোমিটারের মধ্যে অন্য আর একটা বাদা জাল পাতলে কোন জালেই কোন মাছ ওঠে না তাই একই নদীর সাথে সম্পর্কিত দূরদুরান্তের জেলেদেরও নিজেদের মাঝে পারস্পরিক সুসম্পর্ক ও সমবায় মনোবৃত্তি থাকতে হয়।

অশিক্ষিত অন্য দুই ভাইয়ের সাথে সিরাজুলের যোগাযোগ তেমন গভীর না, তারপরও তিন ভাই মিলে অনেক কস্টে বাবার ভিটায় একটা ছোট্ট ১৭ বন্দো টিনের ঘর বানিয়েছিল।প্রাধানত মনজুরুলের পরিবারই সেখানে থাকে। একটা নিম্নমানের গ্রামীণ কাঠের ঘরও মোটামুটি ১৬/১৮ বছর টেকে। ভাল লোহা বা পাকা কড়ই কাঠের ঘর ৭০ থেকে ১০০ বছরও টিকে যেতে পারে কিন্তু কাঠের ঘরের প্রধান শত্রু হলো আগুন। সাধারণত ফাল্গুন-চৈত্র মাসের শুষ্ক আবহাওয়া আর প্রচন্ড তাপদাহের সময় আগুন বাশি লাগে। বৃষ্টিহীন এই সময়টায় যেহেতু সকল জলাশয়গুলো প্রায় শুকিয়ে যায় তাই পানি দিয়ে আগুন নেভাতেও অনেক দেরী হয়ে যায় আর দেরী হলেই সর্বভুক আগুন সব গ্রাস করে নেয়। ঐতিহাসিক ভাবেই গ্রামীণ আগুন জনিত দূর্ঘটনার প্রধান উৎস রান্না ঘরের আগুন তবে ইদানিং আগুনের আর একটা প্রধান উৎস হচ্ছে কাঠের ঘরে ত্রুটিপূর্ণ বৈদ্যুতিক সংযোগ ও ঘরের শুষ্ক কাঠের সাথে এলেবেলে ভাবে লাগানো বৈদ্যুতিক ওয়ারিং এর সর্ট সার্কিট। ইদানিং গ্রামের ঘরগুলোতে আগুন লাগার আরও একটি কারন যুক্ত হয়েছে তা হচ্ছে চার্জ দেয়া অবস্থায় অতি নিম্নমানের নকল মোবাইল ফোন ও ততোধিক নিম্নতরমানের মোবাইল চার্জার বিস্ফোরণ জনিত কারনে আগুনের সুত্রপাত।

দুই শিশু কন্যা তাইয়েবা,তাহেরা আর তরুণী স্ত্রী কে নিয়ে নদীতে বাদা জাল বেয়ে মনজুলের জীবন মোটামুটি চলছিল কিন্তু এই নিম্নমানের মোবাইল চার্জার বিস্ফোরণের আগুনই এক ঝাপটায় ধ্বংস করে দিলো তিন ভাইয়ের মিলিত রক্ত পানি করা স্মৃতিময় কাঠের ঘরটি। এই পর্বে আমি মনজুরুলের পুড়ে যাওয়া সেই ঘরটির ছবি ও সেই পোড়া অবসবাসযোগ্য উদোম ঘরে পুনরায় বসবাসের অসহায় অক্ষম প্রচেষ্টার কিছু ছবি শেয়ার করলাম।

পূর্বের পর্ব