Bangladesh Investment Summit 2025 প্রসঙ্গ: আবাসন শিল্প

Bangladesh Investment Summit 2025 অনুষ্ঠিত হয়ে গেল। বিদেশী বিনিয়োগকারীদের মত দেশী বিনিয়োগকারিদের জন্যও বিনিয়োগ বান্ধব পরিবেশ চাই। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে বিদেশী বিনিয়োগকারিদের জন্য এ’দেশ একটা স্বর্গরাজ্য হতে চলেছে। বিডার এক ছাদের নীচেই এখন প্রকল্পের সকল অনুমোদনের সুবিধা মিলবে! প্রকল্পের জন্য ভূমি অধিগ্রহণও আর কোন ব্যপার না। বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল, রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল ইত্যাদি কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে সরকার স্বয়ং বিনিয়োগকারীদের হয়ে জমি, বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানি ইত্যাদি পরিসেবাগুলি নিশ্চিত করবেন। খুবই আশাব্যঞ্জক কথা। এমনটাই তো হওয়া উচিৎ।
কিন্তু এই সুবিধাগুলো কী দেশীয় সব বিনিয়োগকারীদের জন্যও নিশ্চিত করছেন সরকার? দেশীয় বিনিয়োগকারীদের নিয়ে এমন একটা সম্মেলন করে সেখান থেকে তাঁদের জন্য বিনিয়োগ সুবিধাদির ঘোষনা দিলে দেশের ছোট, বড় হাজার হাজার বিনিয়োগকারিরা উৎসাহ পেতো, সন্দেহ নেই।
একজন স্থপতি হিসেবে দেশের আবাসন শিল্প এবং এই খাতে ব্যবসার পরিবেশ কতটা বিনিয়োগবান্ধব সেই খবর রাখতেই হয়। এদেশে আবাসন শিল্পে বিনিয়োগকারিদের দুরাবস্থার কথা, এর কারণ, প্রভাব ইত্যাদি একটু বলি:
Bangladesh Investment Summit 2025 প্রসঙ্গ: আবাসন শিল্প – দুরাবস্থার প্রকৃত কারণসমূহ
১. সরকারি অনুমোদনের জটিলতা:
আবাসন প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য বিভিন্ন সরকারি সংস্থার কাছ থেকে অনুমোদন নিতে হয়, যার মধ্যে রয়েছে রাজউক, সিটি কর্পোরেশন, পরিবেশ অধিদপ্তর, পানি ও বিদ্যুৎ কর্তৃপক্ষ, ফায়ার সার্ভিস, ভূমি অফিস প্রভৃতি। এই দফতরগুলোর মধ্যে সমন্বয়ের অভাব, দুর্নীতি এবং দীর্ঘসূত্রতা একটি প্রকল্প শুরু করার আগেই সময় ও অর্থের অপচয় ঘটায়। বিশেষ করে ক্ষুদ্র ও মাঝারি ডেভেলপারদের জন্য এই প্রক্রিয়া প্রায় অসাধ্য হয়ে দাঁড়ায়।
ঢাকা শহরের ভবিষ্যৎ গঠন ও পরিকল্পনার জন্য DAP অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হলেও তার বাস্তবায়নে রয়েছে বিস্তর অস্পষ্টতা ও বিরোধ। হঠাৎ করে ভবনের উচ্চতা সীমিতকরণ, প্লট ব্যবহারের বিধিনিষেধ, রাস্তাঘাট ও সেবাসুবিধার অভাব প্রকল্প বিনিয়োগকারীদের মধ্যে অনাস্থা সৃষ্টি করছে। এতে নতুন প্রকল্প কমে গেছে এবং পুরনো প্রকল্পগুলো ঝুলে রয়েছে।
৩. অর্থায়নের অভাব ও গৃহঋণের দুস্পাপ্যতা:
আবাসন খাতে দীর্ঘমেয়াদি ও স্বল্পসুদে অর্থায়ন পাওয়া অত্যন্ত কঠিন। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো গৃহঋণ দিতে অনাগ্রহী এবং যেসব ঋণ দেওয়া হয়, তার সুদের হার অনেক বেশি। আবার গৃহঋণের জন্য প্রাপ্তিযোগ্য আয়, চাকরি বা প্রপার্টি কোল্যাটারালের কঠোর শর্ত অধিকাংশ মধ্যবিত্ত ক্রেতার নাগালের বাইরে। এতে আবাসন ক্রয়ক্ষমতাও কমে যাচ্ছে।
৪. নগর পরিকল্পনায় অদূরদর্শিতা:
নতুন শহর বা স্যাটেলাইট টাউন গঠনের কার্যকর উদ্যোগ না থাকায় মূল শহরের ওপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি হয়েছে। জলাবদ্ধতা, যানজট ও অপরিকল্পিত উন্নয়ন আবাসন খাতের প্রতি মানুষের আগ্রহ কমিয়ে দিয়েছে।
৫. জমির কালোবাজারি:
সরকারের বিভিন্ন আবাসিক প্রকল্প থেকে একজন নাগরিক যে অর্থে জমি বরাদ্দ পান, তার সাথে জমির আকাশচুম্বী বাজারদরের কোন সম্পর্কই নাই। ধানমন্ডি, উত্তরা, গুলশান, বনানী ইত্যাদি আবাসিক এলাকার কথা বাদই দিলাম। হালে পূর্বাচলে মাত্র ৫০ হাজার টাকা কাঠায় বরাদ্দ পাওয়া এক একটা প্লট এখন বিক্রি হয় কাঠাপ্রতি এক থেকে দেড় কোটি টাকায়! জমির এই অনিয়ন্ত্রিত মূল্যের কারনে মধ্যবিত্ত উচ্চবিত্ত বলে কোন কথা নেই, স্বাভাবিক স্বচ্ছ আয়ের যে কোন পরিবারের ক্রয় ক্ষমতার নাগালের বাহিরে চলে গেছে ফ্লাটের মূল্য।
৬. দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ও নির্মাণসামগ্রীর সংকট:
বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অস্থিরতা ও ডলার সংকটের কারণে সিমেন্ট, রড, কাচ, টাইলসসহ অধিকাংশ নির্মাণসামগ্রীর দাম বেড়েছে দ্বিগুণ-তিনগুণ। এর প্রভাব পড়েছে ফ্ল্যাটের মূল্যে এবং প্রকল্পের নির্মাণ ব্যয়ে। মধ্যবিত্তের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যাচ্ছে এসব ইউনিট।
প্রভাবসমূহ –
১. আবাসন শিল্পের মন্দা:
ক্রমাগত প্রকল্প স্থগিত হওয়া, নতুন বিনিয়োগ না আসা, এবং ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস পাওয়ায় অনেক ডেভেলপার প্রতিষ্ঠান লোকসানে পড়ে ব্যবসা গুটিয়ে নিচ্ছে।
২. সহযোগী শিল্পগুলোর ধ্বংস:
আবাসনের সঙ্গে যুক্ত সিমেন্ট, রড, টাইলস, কাঠ, ইলেকট্রিক, স্যানিটারি সামগ্রী, পেইন্টসহ প্রায় ২-৩ শতাধিক ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প বিপর্যস্ত। ফলে ব্যাপক কর্মসংস্থান হারানোর আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
৩. শ্রম বাজারে বিপর্যয়:
নির্মাণশ্রমিক, ইলেকট্রিশিয়ান, রাজমিস্ত্রি, প্লাম্বারসহ কয়েক লাখ শ্রমিক কর্মহীন হয়ে পড়েছে। এটি গ্রামীণ অর্থনীতিতেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে, যেখান থেকে এই শ্রমিকরা আগত হয়।
৪. নগরায়ণ ব্যাহত:
ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার জন্য প্রয়োজনীয় আবাসনের ঘাটতি বেড়েই চলছে। ফলে বস্তি ও অননুমোদিত বাসস্থানের সংখ্যা বাড়ছে, যা নগরের সার্বিক জীবমানকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।
এবার দেখা যাক এই শিল্পের আকার কতটা বিশাল:
২০১৯ সালের হিসেবে রিয়েল এস্টেট ও হাউজিং খাত দেশের মোট দেশজ উৎপাদনের ৭.৮% অবদান রেখেছে, টাকার অংকে যার পরিমান প্রায় দেড় লক্ষ কোটি টাকা।
২০২৪ সালে এই শিল্পের বাজারের আকার ছিল সাড়ে চার লক্ষ কোটি টাকা, যা বেড়ে ২০২৯ সাল নাগাদ প্রায় আট লক্ষ কোটি টাকায় বাড়ার পূর্বাভাস রয়েছে।
এই শিল্পের সাথে কমবেশি প্রায় দশ লক্ষ মানুষের কর্মসংস্থান জড়িত।
সম্ভাব্য করণীয়:
১. এক জানালা সেবা চালু করা: সব ধরনের সরকারি অনুমোদন একটি কেন্দ্রীয় ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম থেকে দ্রুততম সময়ে প্রদান নিশ্চিত করা।
২. DAP বাস্তবায়নে স্বচ্ছতা ও স্থিতিশীল নীতিমালা: দীর্ঘমেয়াদি ও বাস্তবসম্মত পরিকল্পনা বাস্তবায়ন, যেখানে বিনিয়োগকারীদের আস্থা অর্জন করা যাবে।
৩. আবাসিক এলাকা পরিকল্পনায় ব্যক্তি প্রতি ৩, ৫, ১০ কাঠা সাইজের প্লটের পরিবর্তে ন্যুনতম এক একরের প্লট হিসেবে আবাসিক এলাকার পরিকল্পনা প্রণয়ন করা এবং প্রতিষ্ঠিত ডেভলপার বা গ্রপ ভিত্তিক প্লট বরাদ্দের ব্যবস্থা রেখে বহুতল ভবন নির্মাণের পথকে সুগম করা।
৪. স্বল্পসুদের গৃহঋণ: মধ্যবিত্ত ও নিম্ন-মধ্যবিত্তের জন্য সাবসিডিযুক্ত গৃহঋণ চালু করা।
৫. বিকল্প শহর ও পরিকাঠামো উন্নয়ন: রাজধানীর বাইরে সাশ্রয়ী ও আধুনিক আবাসন প্রকল্পে বিনিয়োগ বৃদ্ধি।
৬. নির্মাণসামগ্রীর দাম নিয়ন্ত্রণে উদ্যোগ: ভর্তুকি, কর ছাড় বা স্থানীয় উৎপাদন উৎসাহ দিয়ে খরচ কমানোর পদক্ষেপ নেওয়া।
২০১০ সাল পর্যন্ত বেসরকারি উদ্যোগে ক্রমাগত বিকাশমান এই আবাসন শিল্প দেশের নাগরিকদের বাসস্থান সংস্থানের চাহিদা পুরনে সক্ষমতার প্রায় দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে যাবার উপক্রম হয়েছেলো। কিন্তু সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতরগুলির ভ্রান্ত নীতি, প্রখর নজরদারির অভাব, নিয়ন্ত্রন হীনতা, এবং এই শিল্পের বিকাশে নীতিনির্ধারকদের ব্যবসাবান্ধব সিদ্ধান্ত গ্রহণে অনীহা ও অদক্ষতা, এই খাতের প্রতি সীমাহীন গুরুত্ব ও যত্নহীনতা একে আজ ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে এসেছে।
একছাদের নীচ থেকে বিদেশী বিনিয়োগকারিদের যেসব সুবিধাদির প্রতিশ্রুতি দিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার তাঁদের আকৃষ্ট করছেন, দেশীয় বিনিয়োগকারীদের প্রায় সমমানের সুবিধাদি ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা দিলে দেশীয় শিল্পের সব খাত থেকে দেশজ উৎপাদনে যে বিপুল সাফল্য আসবে তাতে কোন সন্দেহ নাই।
সরকারের উচিৎ, বিদেশী বিনিয়োগকারীদের মতো একই অগ্রাধিকারে দেশীয় বিনিয়োগকারীদের জন্যও একটা সমমানের বিনিয়োগ বান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করা।
Related