DAP_2022-2035

ড্যাপ_২০২২-২০৩৫-আমরা গুরুতর বিপদে আছি

ড্যাপ_২০২২-২০৩৫-আমরা গুরুতর বিপদে আছি

-স্থপতি তাসলিহা মওলা দিশা, ব্যবস্থাপনা পরিচালক, স্কিমটা কনসালটেন্টস, ঢাকা
ঢাকা শহরকে সাজিয়ে গুছিয়ে তুলতে পরিকল্পনা – নতুন কোন বিষয় নয়। সেই ১৯১৭ সালে প্যাট্রিক গেড্ডেসের পরিকল্পনা থেকে শুরু করে হাল আমলের ড্যাপ_২০২২-২০৩৫ বা বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা ২০১৬-২০৩৫ সবই ঢাকার অধিবাসীদের জীবন যাত্রার মানোন্নয়নের জন্য গৃহীত ব্যয় সাপেক্ষ কতিপয় পদক্ষেপ। এতদস্বত্ত্বেও ঢাকার পরিবর্তন সেই অর্থে আমরা কি দেখতে পাই? জীবন যাত্রার মান সেভাবে কি উন্নত হচ্ছে?
ঢাকায় পরিকল্পনা বলতে আমরা যা দেখি তা আসলে Trouble shooting এর পর্যায়ে পড়ে। কোন এক বিচিত্র কারণে এতগুলো পরিকল্পনার কোনটিই বাস্তবায়িত হয়নি। ঢাকার উন্নতি সাধন তাই বার বার মুখ থুবড়ে পড়েছে। শুধু তাই নয়, প্রতিটি পরিকল্পনা প্রণয়নের পর ঢাকা ও এর আশেপাশের এলাকা সমূহ দেখে এটাই মনে হয়েছে –“No planning is always better than planning”।
ঢাকার জন্য প্রথম মহাপরিকল্পনাটি গৃহীত হয়েছিল ১৯৫৯ সালে। কিন্তু সেটি পরবর্তীকালে ওগিয়ে যাওয়া বিশ্ব নগর গুলোর তুলনায় অনেকদিক থেকেই পিছিয়ে ছিল। দ্বিতীয় মহাপরিকল্পনাটি প্রণীত হয় ১৯৯৬ সালে যেটা Dhaka Metropolitan Development Plan DMDP 1995-2015 নামে পরিচিত। মোট ১৫২৮ বর্গকিমি জুড়ে এই মহাপরিকল্পনাটি প্রণীত হয়। এই মহাপরিকল্পনার তিনটি ধাপ বা Tire ছিল।

১। Dhaka Structure Plan

২। Dhaka Urban Area Plan

৩। Detailed Area Plan

কিন্তু এই মহাপরিকল্পনাটিও কমবেশী কাগুজেই রয়ে গেছে, বলা ভাল এটিও আলোর মুখ দেখেনি। উপরন্তু রাজউক প্রতিপদেই DMDP এর violation করেছে। প্রকৃষ্ট উদাহরণ হল পূর্বাচল নিউ টাউন। Structure Plan 1995-2015 এ পূর্বাচল, ঝিলমিল, জলসিঁড়ি আবাসন প্রমুখ জায়াগাগুলোকে প্লাবন ভূমি, কৃষি জমি, জলা ভূমি ইত্যাদি দেখানো হলেও পরবর্তীতে রাজউক নিজের প্ল্যান নিজেই violate করে এ সকল আবাসন প্রকল্পের পরিকল্পনা গ্রহণ করে DAP 2010 এর মাধ্যমে এগুলোর বৈধতা দিয়ে। এ সকল আবাসন প্রকল্প ঢাকা ও এর আশেপাশের বাসিন্দাদের কাছে লোভনীয় এবং আমাদের “Land is the ultimate commodity” – এই মানসিকতাকে আরো উজ্জীবিত করেছে। এ সকল সরকারী আবাসন প্রকল্প বেসরকারী ভূমি ব্যাবসায়ীদেরও আকৃষ্ট করেছে প্রকল্পগুলোর আশেপাশের কৃষিজমি, জলাভূমি, খাল, বিল ও প্লাবন ভূমিকে আবাসন প্রকল্পে রূপান্তরিত করতে। অথচ ঢাকার জন্য DMDP 1995-2015 এ গৃহিত নীতিমালা ও পরিকল্পনা সমূহ যথেষ্টই সময়োপযোগী ছিল এবং সেগুলোর সঠিক বাস্তবায়ন অনেকাংশেই ঢাকা ও এর আশেপাশের পরিবেশকে রক্ষা করতে সক্ষম হত।
নানাবিধ রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক জটিলতায় বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা ২০১০ অসমাপ্তি থেকে যায় এবং পরবর্তিতে ঢাকার জন্য অতি সম্প্রতি Dhaka Structure Plan 2016-35 তৈরী করা হয়। এবং খুবই হতাশার সাথে লক্ষ করা যায় যে DSP 2016-35 মূলতঃ ভূমি ব্যবসায়ী বলা ভাল ভূমি দস্যুদের স্বার্থ রক্ষার্থেই বেশী কাজ করবে। DSP 2016-35 গেজেটেড হবার আগেই হাল আমলে সবচাইতে বেশী আলোচিত যে মহাপরিকল্পনা তা হল ঢাকা বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা ২০১৬-৩৫। মূলতঃ ঢাকা শহরের আশেপাশে যাও বা খালি জমি আছে, এ পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে তাও থাকবেনা। যদিও এর সাথে জড়িত ব্যাক্তিবর্গের ভাষ্যমতে এ ঢাকার জন্য এর চাইতে ভাল কোন পরিকল্পনা আগে গৃহীত হয়নি।

ড্যাপ_২০২২-২০৩৫

পরিকল্পনার শুরুতে্ এর মূল চারটি লক্ষ্যে চোখ রাখলে বোঝা যাবে এর গোড়াতেই গলদ। সেগুলো দেখা যাক;

ক. বিনিয়োগের সার্বজনীন স্বাধীনতা

খ. উন্নত জীবনমান

গ. সহনশীল শহর

ঘ. বাস্তুসংস্থান সংরক্ষণ ও পুনরুজ্জীবন

দেখে প্রথম যে কথাটি মাথায় আসে তা হল, upside down। জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে সমগ্র তৃতীয় বিশে যেখানে সোচ্চার সেখানে পুরো ক্রমটি নিচ থেকে শুরু হওয়া উচিত ছিল। পুরো রিপোর্টে এই গলদের প্রভাব খুব ভালভাবেই পড়েছে। আদতে মনে হচ্ছে সংশ্লিষ্ট ব্যাক্তিবর্গ বুঝতেই পারেননি ঢাকার মুল সমস্যা গুলো অথবা ইচ্ছে করেই পাশ কাটিয়ে গেছেন।
এই পরিকল্পনার নির্ধারিত ভূমি ব্যাবহার এলাকা বা Land Use Zone এর দিকে নজর দিলে আরো হতাশ হতে হয়। একটু চোখ বোলাই;

১। কৃষি অঞ্চল

২। বনাঞ্চল

৩। উন্মুক্ত স্থান

৪। মিশ্র ব্যাবহার এলাকা ০১, ০২, ০৩, ০৪, ০৫

৫। প্রাতিষ্ঠানিক এলাকা

৬। ভারী ও দুষনকারী শিল্প এলাকা

এখানে কোথাও জলাভূমি, বা প্লাবনভূমির উল্লেখ নেই। কারণ জলা ভূমি ও প্লাবন ভূমির ব্যবহারকে হালের বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনায় কৃষি হিসেবে দেখানো হয়েছে। এখানেই প্রশ্ন এসে দাঁড়ায় কেন এই সিদ্ধান্ত? কোন কোন তথ্য উপাত্ত ও স্থিতিমাপক (parameter) এর ভিত্তিতে এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে?

ড্যাপ_২০২২-২০৩৫

রিপোর্টে বলা আছে ঐতিহাসিকভাবে এ সকল জলাভূমি ও বন্যাপ্রবাহ অঞ্চলের ব্যাবহার কৃষি। কিন্তু আদৌ কি সকল বন্যাপ্রবাহ অঞ্চলেই কৃষি কাজ করা হত? তা নিশ্চয়ই হতনা। সংশ্লিষ্ট উচ্চপদস্থ ব্যাক্তির মতে এতে করে ভূমি ব্যাবহার পরিবর্তন কঠিন হবে। মনে প্রশ্ন জাগে আদৌ কি তা হবে নাকি হারাতে হবে অবশিষ্ট কৃষি জমিও? রিপোর্টের এই অংশে অনেক অসংগতি লক্ষ্য করা যায়। যেমন এখানে অনুচ্ছেদ ৩.৬.৬ এ, স্ব স্ব ভু আচ্ছাদন নীতিমালায় বলা হয়েছে;
“বিদ্যমান ভূমি ব্যবহার কৃষি হলে এবং ভূমির মালিক ছাড়া অন্য কারো মাধ্যমে ভূমি ব্যাবহার ভূমির মালিককে উন্নয়ন মূলক কর্মকান্ড বা ব্যাবসায়ের অংশীদার হিসেবে গণ্য করতে হবে”। যদি তাই হয়ে থাকে, কৃষিকাজে জড়িত মানুষটি খুব সহজেই নিজের জমির মালিকানা ছেড়ে দিতে রাজি হবে। দিন শেষে লাভের অংক সকলেই বোঝে।

ড্যাপ_২০২২-২০৩৫

আরো বলা আছে “ভূমি ব্যবহার কৃষি থেকে নগরাঞ্চলে পরিবর্তনের প্রক্রিয়াকে কৃষকের ব্যক্তিগত ইচ্ছা ও প্রয়োজনের অধীন করতে হবে”। কোন স্বপ্নের দেশে সংশ্লিষ্ট ব্যাক্তিবর্গ বাস করেন তা আসলে আমাদের মত মানুষদের বোধগম্য হচ্ছেনা। এই মহা পরিকল্পনাটি আসলেই কি সাধারণের কোন উপকারে আসবে? নাকি ভূমি দস্যুদের আখের গোছানোর কাজেই ব্যবহৃত হবে?

বর্তমান ড্যাপ এ মানুষের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য এবং সামাজিক বন্ধন ও বোঝাপরার জন্য ক্ষতিকর উল্লেখ করে সুউচ্চ আবাসিক ভবন নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। আরো বলা হয়েছে বিশেষ করে শিশু কিশোরদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর এইসব সুউচ্চ আবাসিক ভবন। সারাবিশ্ব এখন sprawl এর বিপক্ষে। Urban permeable land বাড়াতে হলে আমাদের উঁচুতে উঠতেই হবে, কারন বলা হচ্ছে ২০৫০ সাল নাগাদ বিশ্বের ৫০ ভাগের বেশী মানুষ নগর জনসংখ্যার অন্তর্ভুক্ত হবে। সারাবিশ্ব যেখানে একশ বছর এগিয়ে চিন্তা করছে, বর্তমান ড্যাপ রিপোর্ট পড়লে মনে হবে আমরা ষাটের দশকের রোমান্টিসিজম নিয়েই পড়ে আছি।
ঢাকার জন্য সবচাইতে সময়োপযোগী ও স্মার্ট মহাপরিকল্পনা বলতে গেলে Dhaka Metropolitan Development Plan DMDP 1995-2015। যা সঠিকভাবে বাস্তবায়িত হলে ঢাকা ও এর চারপাশ নিয়ে আজ আর এতটা ভাবতে হতনা।
পরিশেষে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, DSP 2016-35 যদি ঢাকা শহরের মৃত্যু পরোয়ানা জারি করে তবে ঢাকা বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা ২০২২-২০৩৫ কফিনের শেষ পেরেক ঠোকার কাজটি করে দিতে খুব ভাল ভাবে প্রস্তুত”।
ড্যাপ_২০২২-২০৩৫ বিষয়ে আরো মতামত জানতে ক্লিক করুন

2 thoughts on “ড্যাপ_২০২২-২০৩৫-আমরা গুরুতর বিপদে আছি

Comments are closed.