কড়াইল বস্তি : থেকেই যাবে কী?
কড়াইল বস্তি : থেকেই যাবে কী?
প্রকৌশলী এমদাদুল ইসলাম। প্রাক্তন প্রধান প্রকৌশলী, রাজউক, ঢাকা
কড়াইল বস্তি র অবস্থান ঢাকার অভিজাত আবাসিক এলাকা- বনানীর লেকপাড়ে। কখন কিভাবে এর নাম ‘কড়াইল’ হলো- তা জানিনা! তবে বনানীর জন্মের আগে 1956 সালে তৎকালীন পাকিস্তান টিঅ্যান্ডটি মন্ত্রণালয় কর্তৃক এখানে 170 একর জমি হুকুম দখল করা হয়- যার অংশবিশেষে সে সময় টিঅ্যান্ডটি বিভাগের কিছু অফিস ও অন্যান্য স্থাপনা নির্মিত হলেও অবশিষ্ট জায়গায় একটি স্যাটিলাইট স্টেশন নির্মাণের জন্য সংরক্ষণ করা হয়। কিন্তু সেখানে আজ অবধি আর এই স্যাটিলাইট স্টেশনটি নির্মিত হয়নি এবং টিঅ্যান্ডটির কর্মচারী ও স্থানীয় একটি চক্রের মাধ্যমে এই জায়গাটির উল্লেখযোগ্য জায়গাই বেদখলে চলে যায়।
আশির দশকে গুলশান-বনানীতে জনবসতির বিস্তার হতে শুরু করলে তখন প্রথমে এসব বাসাবাড়ীর ড্রাইভার ও কাজের লোকদের আবাসস্থল হিসেবে গড়ে ওঠে টিঅ্যান্ডটির এই খালি জায়গাটিতে। অতঃপর গার্মেন্টস শিল্প, রিকশাওয়ালা, কাজের বুয়া, সিকিউরিটি সার্ভিসেসের লোকজন ও অন্যান্য নিম্ন আয়ের লোকজন এখানে বসবাস করতে শুরু করে। এভাবে এখন এখানে হাজার-লক্ষ ঘরবাড়ী। কাঠ- বাঁশ-টিনের তৈরী একেকটি ছোট্ট ছোট্ট ঘর/রুমের ভাড়া তুলনা করলে গুলশান-বনানীর চেয়ে কম নয়! শুধু তাই নয়, সরকারী এই জমি এখন বিকল্পভাবে ষ্ট্যাম্পেও কেনাবেচা ও হাতবদল হচ্ছে।
বর্তমানে এটিই ঢাকা তথা দেশের সবচেয়ে বড় বস্তি। প্রতিনিয়ত বনানী লেক দখল করে এখানে টিন-কাঠের দুই-তিন তলা ঘরবাড়ী নির্মিত ও সম্প্রসারিত হচ্ছে, যার পেছনে রয়েছে বরাবর সরকার দলীয় একটি চক্র। নগরীর অনেক সন্ত্রাসীর বসতও এই বস্তিতে। এখানে এখন ওয়াসার পানি, তিতাসের গ্যাস ও ডেসকোর বিদ্যুত রয়েছে। একটি খুব ছোট্ট কক্ষ বা বেড়ের ভাড়া তিন থেকে চার হাজার টাকা, যার উল্লেখযোগ্যই যায় ক্ষমতাধর চক্রটির পকেটে। এছাড়া বিভিন্ন উছিলায় এখানে চাঁদাবাজি একটি নিত্য নৈমিত্তিক বিষয়।
নামে কড়াইল বস্তি হলেও এখন এই জায়গাটি মূলত ‘জামাই বাজার’ ও ‘বউ বাজার’ দুটি ইউনিটের নামেই বেশি পরিচিত। তাছাড়া এখানে রয়েছে এলাকাভিত্তিক অনেকগুলো বস্তি – যেমন কুমিল্লা পট্টি, বেলতলা, গোডাউন, পশ্চিমপাড়া, পূর্বপাডা, উত্তরপাড়া, মোসা, বাইদাপাড়া, এরশাদনগর ইত্যাদি নামের অনেকগুলো বস্তি। আর প্রায় ঘর/বস্তিতে রয়েছে টিভি ও ফ্রিজ। এমনকি এই বস্তিটির কিছু ঘরে এয়ার কন্ডিশন চলে বলেও শোনা যায়!
স্বাধীনতার পর এরশাদ সরকারের আমলেই প্রথম এই জায়গাটির একটি পরিকল্পিত উন্নয়নের প্রচেষ্টা চলে। মহাখালী (ব্রাক সেন্টার সামনে ও গউসুল আজম মসজিদের পূর্ব পার্শ দিয়ে) থেকে বনানী লেকের উপর দিয়ে একটি ব্রীজ নির্মাণের জন্য উদ্যোগ নেয়া হয়, কিন্তু তখন এলাকাটির দখলদার চক্রের কারণে সেটির বাস্তবায়ন হয়নি। অতঃপর 1/11 এর সেনা-সমর্থিত তত্বাবধায়ক সরকারের আমলেও এই এলাকায় সরকারী কর্মচারীদের আবাসন নির্মাণের কিছু চেষ্টা হয়, কিন্তু তাও ওই চক্রটির প্রভাবে বন্ধ হয়ে যায়। তবে বহু কষ্টে আমি রাজউকে থাকা অবস্থায় এই এলাকাটির পূর্ব দিকে Walkway নির্মাণ করে বনানী লেক দখল করাকে প্রতিহত করার চেষ্টা করেছি। কিন্তু মহাখালী অংশে এখনো লেকের জমি দখল ও ঘরবাড়ী নির্মাণ অব্যাহত আছে।
এই অবস্থায় বর্তমান মহানগরী ঢাকার কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থিত এই বস্তিটির জায়গা উদ্ধার ও উচ্ছেদ করা হবে কিনা তা এখন খুবই সন্দেহের বিষয়ে পরিণত হয়েছে!! উত্তর ঢাকার মেয়র মহোদয়কে দেখছি-তিনি নগরীর পূর্ব-পশ্চিমে কত কিছু করছেন, কিন্তু এই বস্তিটি নিয়ে একেবারে নিশ্চুপ!!
উল্লেখ্য, এই এলাকায় রয়েছে একটি বড় খেলার মাঠ- যেটি এক সময় নগরীতে খুবই ভাল মাঠ হিসেবে পরিচিত ছিল, কিন্তু এখন এটি একটি মরুভূমির ন্যায় ও খুবই খারাপ অবস্থায়। অন্যদিকে এককালের প্রচন্ড পাওয়ারফুল টিঅ্যান্ডটি মন্ত্রণালয় এবং টিঅ্যান্ডটি বিভাগও (বর্তমানে বিটিসিএল) এই ডিজিটাল যুগে এখন একটি প্রায় ধংসপ্রাপ্ত মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের ন্যায়। তাই এই জমিটি অবৈধ দখল থেকে উদ্ধারপূর্বক সেখানে সরকার সময়োযোগী নতুন কিছু করার পরিকল্পনা করতে পারে।