গ্রামীণ কাঠের ঘর এর নকশা
গ্রামীণ কাঠের ঘর এর নকশা
[লেখকঃ স্থপতি মাহফুজুল হক জগলুল, প্রধান স্থপতি, ইন্টারডেক সিস্টেমস, ঢাকা]
গ্রামীণ কাঠের ঘর নকশা ঃ নানানরকম কাঠের কারুকাজ গ্রামীণ ঘরের একটা অবিচ্ছেদ্য অনুসঙ্গ, বিশেষ করে যে ঘরগুলো একদম প্রান্তিক পর্যায়ের না সেগুলোতে কিছু না কিছু কারুকাজ বা অলংকরণ থাকবেই। যাদের কাঠ খোদাই বা কারুকাজের আর্থিক সামর্থ্য নেই তাদের ঘরের সদর দরোজায়ও দেখা যাবে সস্তা রঙিন আলতার আলপনা দিয়ে হলেও কিছু না কিছু অলংকরণের চেস্টা আছে আর সেই আলতার আলপনার গ্রাফিকসটি নির্গত হয়েছে ঘরের বধূটির জন্ম জন্মান্তরের রক্তধারার সহজাত নিস্কলুষ শিল্পবোধের নিংড়ানো নির্যাস থেকে। নগরে বেড়ে ওঠা এই আমি জীবনেও সেই আলপনা আঁকতে পারবোনা।
ছবির এই কাঠাল কাঠের ( ছবিতে ঘন খয়েরী-কালো বার্নিশ করা) উপর নিখুঁত ও নিবিড় কার্ভিং করা দুই পাল্লার দরোজাটা আমি পেয়েছিলাম আমার উদয়কাঠি গ্রামের ধলু কাজী নামের এক অন্ধ গরীব কৃষকের ঘর থেকে। আমার মনে হয় এই কাঠের কাজ পৃথিবীর যে কোন উচ্চ শ্রেনীর কাজের সাথে তুলনীয়। এই কাজটি দেখার আগে কাঠের কাজের যে এতো নিখুঁত ডিটেইল হতে পারে আমি জীবনেও ভাবতে পারিনি ।
কোন নাম না জানা এক সুদক্ষ কারিগর সেই কোন সুদূর অতীতে এই খোদাই কাঠের এই মহাকাব্য রচনা করেছিল ধলু কাজী তা বলতে পারেনা, সে এটা বংশ পরম্পরায় তার বাবার কাছ থেকে পেয়েছে। পঞ্চদশ শতকের সোনা মসজিদের পাথরের কার্ভিংয়ের ফ্লোরাল প্যাটার্ন বা ষোড়শ শতকে বাঘা মসজিদের টেরাকোটার ফ্লোরাল প্যাটার্নের সাথে একটা ধারাবাহিকতার সাজুয্য এই গ্রামীণ দরোজার কাজের মধ্যে আমি টের পাই।
কারুকাজ সবসময়ই শুধু অলংকরণের জন্য নয়, কখনো কখনো তা ঝালর বা পর্দা অথবা ভেন্টিলেটর হিসেবেও খুব সার্থক ও লাগসই ভাবে ব্যবহৃত হয়েছে।
এখানে শেষের দিকে যে কারুকাজের ছবিগুলো আছে সেগুলো পিরোজপুরের পাশের জেলা বাগেরহাটের মোড়েলগঞ্জের চিংড়াখালি গ্রামের বিখ্যাত জুরুন্দি খানের বাড়ির কাজ। এগুলো এখনো হুবহু এমনই আছে।
আমরা এমন এক জাতি যারা মাত্র এক মিনিটে যে পিঠাটি কুড়কুড় করে খেয়ে ফেলি সেই পিঠাটিও পরম দরদ দিয়ে ২০ মিনিট ধরে নকশা করে দিনের পর দিন রোদে শুকাই তারপর কষ্ট করে তেলেভেজে যত্নকরে রেখে দেই প্রিয় মানুষের জন্য…….. কারুকাজ, আলপনা, অলংকরণ এই অনুসঙ্গগুলো পদ্মা, মেঘনা, ব্রম্মপুত্র বিধৌত এই বিশাল জনপদের মানুষের রক্তের মধ্যে গভীর মমতায় নকশা কেটে চলছে হাজার বছর ধরে।