মুঘল আমলের সেতুসমূহ

মুঘল আমলের সেতুসমূহ পর্ব-৩

মুঘল আমলের সেতুসমূহ পর্ব-৩

শাহরিয়ার হাসান মৃধা রাতুল, প্রধান স্থপতি, মৃধা’জ ড্রয়িং হাউজ, নারায়ণগঞ্জ

মুঘল আমলের সেতুসমূহ –“ঐতিহাসিক: “সেতু” অথবা, “পুল” স্থাপনার হালখাতা। ফিরে দেখা সেকাল:বাস্তব পর্যবেক্ষণ ও যুগোপযোগী চিন্তা-ভাবনা।

মুঘল আমলের সেতুসমূহ পূর্বের দুটি পর্বের পর তৃতীয় পর্বের শুরু।

মুঘল আমলের সেতুসমূহ চাপাতলীর ইটের পুল,প্রাচীন কত্রাভু সংলগ্ন

স্থাপত্য সময় : : মুঘল আমল

চাপাতলীর ইটের পুলের অবস্থান : : নারায়ণগঞ্জ জেলার ইস্পাহানি বাজার সংলগ্ন চাপাতলী গ্রামে অবস্থিত এই চাপাতলীর ইটের পুল। স্থানীয় লোকজন এই পুলকে গায়েবি সেতু নামে অবহিত করে থাকে।

মুঘল আমলের সেতুসমূহ

চাপাতলীর ইটের পুলের ম্যাটেরিয়াল : : চাপাতলীর ইটের পুল ইটের তৈরী। এই পুলের মধ্যে ইটের প্যাটার্ন এ বৈচিত্র্য দেখা যায়। প্যাটার্ন এ দুই ধরণ দেখা যায়, যেমন : : লম্বালম্বিভাবে ইটের আধান, আড়াআড়িভাবে ইটের আধান। ইটের প্যাটার্ন এ রো – চারটি। বামদিক থেকে ২ নং রো টি অনেক ছোট ,৩ ও ৪ নং রো টি সর্বাপেক্ষা বড়।

ইটের আকৃতি বেশ লম্বালম্বি। চাপাতলীর ইটের পুল পরিদর্শনে আমরা দেখতে পাই, ইটের দৈর্ঘ্য ৭ ইঞ্চি, প্রস্থ ২ ইঞ্চি।

চাপাতলীর ইটের পুল এর স্থাপত্য বৈশিষ্ট্য  : ইটের পুল এর দৈর্ঘ্য ঢাল সহ ১০৮ ফিট, প্রস্থ = প্রায় ১৮ ফিট, উচ্চতা =প্রায় ২৪ ফিট (পানি থেকে)

চাপাতলীর ইটের পুল এর অষ্টকোণাকৃতি টাওয়ার : :

  • ইটের পুল এর ৪ পাশে ৪ টি অষ্টকোণাকৃতি টাওয়ার এর ভগ্নদশা রয়েছে।
  • অষ্টকোণাকৃতি টাওয়ার এর প্রতি বাহুর দৈর্ঘ্য, ৩ ফিট ৪ ইঞ্চি
  • অষ্টকোণাকৃতি টাওয়ার এর সম্পূর্ণ দৈর্ঘ্য, ৮ ফিট
  • অষ্টকোণাকৃতি টাওয়ার এর সম্পূর্ণ প্রস্থ, ৬ ফিট
  • অষ্টকোণাকৃতি টাওয়ার এর উচ্চতা, প্রায় ১০ ফিট (মাটি থেকে)
  • অষ্টকোণাকৃতি টাওয়ার থেকে ল্যান্ডিং, ৭ ফিট প্রায়।

চাপাতলীর ইটের পুল এর রেলিং : :

মুঘল আমলের সেতুসমূহ

ইটের পুল এর রেলিং এ ভগ্নদশা দেখা যায়। এই রেলিং এর পুরুত্ব, ১ ফিট ৮.৬ ইঞ্চি (প্রায়)

পাগলা পুল,পাগলা, বেগ মুরাদের দূর্গ সংলগ্ন।

পাগলা সেতুর পরিচয় : মুঘল আমলে যে কয়টা নান্দনিক সেতু’র কথা বলা হয় তার মধ্যে প্রকৃষ্ট উদাহরণ “পাগলা সেতু” বা, “পাগলা ব্রীজ”। বহু ইতিহাসবেত্তা এই সেতু সম্পর্কে গল্প করেছেন।

পাগলা সেতুর অবস্থান  : : ঢাকা থেকে ৪.৫ কিলোমিটার অদূরে নারায়ণগঞ্জের পাগলা এলাকায় এই সেতুর ধ্বংসাবশেষ এখনো টিকে রয়েছে।

পাগলা সেতুর ইতিহাস : :বাংলার সুবাদার মীর জুমলা তার সুবাদার থাকাকালীন সময়ে ঢাকা ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকাসমূহ , বিশেষ করে নারায়ণগঞ্জ শহরে বেশ কিছু মুঘল স্থাপনা গড়ে তোলেন। তার নির্মিত  এইসব স্থাপনার মধ্যে রয়েছে – প্রাচীন রাস্তা, পরিখা, সেতু ও সংযোগ সড়ক ইত্যাদি।

মুঘল আমলের সেতুসমূহ

ধারণা করা হয়, বাংলার সুবাদার থাকাকালীন “মীর জুমলা” এই বাংলায় ১৬০০ শতক থেকে ১৬৬০ শতক পর্যন্ত এই বাংলায় বেশ কটা দূর্গ নির্মাণ করেছেন। এইসব দুর্গের মধ্যে রয়েছে- সুবর্ণকান্দি দূর্গ (বর্তমান সোনাকান্দা দূর্গ ), খিজিরপুর দূর্গ (বর্তমান হাজীগঞ্জ দূর্গ ), বেগ মুরাদের দূর্গ ইত্যাদি।  প্রতিটা দূর্গ সমেত এলাকায় তিনি এক একটি পরিখা খনন করেন ও সেতু নির্মাণ করেন। যেমন সোনাকান্দা দূর্গের কাছে ত্রিবেণী খাল ও ত্রিবেণী সেতু, হাজীগঞ্জ দূর্গের কাছে কেল্লার পুল ও কেল্লার পুল সেতু, বেগ-মুরাদের দূর্গের কাছে ছিল পাগলা নদী  ও পাগলা পুল নির্মাণ করেন। ১৬৬০ খ্রিষ্টাব্দে এই দূর্গ নির্মাণের কাজ শেষ হয়। ১৬৬৬ খ্রিষ্টাব্দে ফরাসী পর্যটক টেভারনিয়ার ঢাকায় এসেছিলেন ভ্রমণে। তখন তিনি এই পাগলা সেতুর সৌন্দর্য্য উপভোগ করেছিলেন। তিনি তার লেখনীতে এই পাগলা সেতুর বর্ণনা তুলে ধরেছেন। তার বর্ণনা অনুযায়ী এই সেতুকে উল্ল্যেখ করেছেন ‘ইটের একটি সুন্দর সেতু’ নামে। তার বর্ণনা অনুযায়ী -ভাটিতে আছে আরেকটি নদী পাগলা। নদীর ওপর আছে সুন্দর একটি পুল, যা তৈরি করেছিলেন মীর জুমলা। তিনি আরো লিখেছিলেন, নদীর দুই পাশে ছিল বেশকিছু টাওয়ার, যেখানে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল ডাকাতদের কাটা মুণ্ড।

১৮২৪ সালে কলকাতার লর্ড বিশপ হেবার, পাগলা পুলের সৌন্দর্যের খ্যাতি শুনে তা দেখতে এসেছিলেন। অতোদিনে পাগলা নদীও মৃতপ্রায়।  পাগলা সেতু তখন পরিণত হয়েছিল প্রায় ধ্বংসস্তূপে।

পাগলা সেতুর গাঠনিক উপাদান:: চার্লস ড’য়লির আঁকা ছবি থেকে “পাগলা সেতু” সম্পর্কে অনেক ধারণা পাওয়া যায়। তার ছবির বর্ণনা অনুযায়ী –

  • আকর্ষণীয় টিউডার গথিক স্থাপত্যের এক চমৎকার নিদর্শন।
  • তিনটি খোলা খিলানের সমন্বয়ে গঠিত এই পাগলা সেতু।উভয় পাশে খিলানযুক্ত।
  • পাগলা সেতুতে ছিল পর্যবেক্ষেন টাওয়ার। শক্রদের ওপর নজর রাখার জন্য এতে ‘পর্যবেক্ষণ টাওয়ার’ যুক্ত ছিল।
  • পাগলা সেতুর প্রায় অর্ধাংশ ভেঙ্গে গিয়েছিলো। ঠিক যেন বড় রকমের ঝড় কিংবা ঘূর্ণিঝড়ে পতিত হয়ে ভেঙ্গে পড়ছে এই সেতু। পর্যবেক্ষণ টাওয়ার এর উপরে ছিল গম্বুজ আকৃতি সদৃশ।
  • অনেক বেশি আর্ক্ লাইন এর ব্যবহার
  • অনেকে বেশি অলংকরণশৈলীর ব্যবহার
  • মিনারের মতো অবশিষ্ট অংশ দেখা যায়
  • প্রতিটি কোণায় চারটি অষ্টভুজাকার মিনার ছিল। এই মিনারগুলো ফাঁপা আকৃতির।
  • সেতুর দুই পার্শ্বে রয়েছে রেলিং বরাবর স্থানের পুন্: পুন্ : পিলার এর ব্যবহার
  • পিলারের মাথায় ছোট ছোট গম্বুজের ব্যবহার

অ্যাটকিনসন জানান, ‘পুলের জায়গাটিতে এক ধরনের আলো-ছায়ার খেলা দেখা যায়। দূরের ঢাকার ইউরোপিয়ান অধিবাসীদের সাদা ঘরবাড়িতে সূর্যের আলো ঠিকরে পড়ে যে উজ্জ্বলতার সৃষ্টি করে, তার সঙ্গে পুল ও পুলের নিকটবর্তী ভূমির ছায়া মিলে অদ্ভুত এক ভাবপ্রবণ দৃশ্যের অবতারণা করে।

খাঁজা আম্বার পুল: প্রাচীন “রেনেল” এর ম্যাপে “খাজা আম্বার পুল “এর অস্তিত্ব দেখা যায়। ম্যাপ অনুযায়ী ঢাকার মধ্যভাগে এক সময় এই সেতুর অবস্থান ছিল। যা বর্তমানে টিকে নেই। খাজা নাম্বার সেতু ১৬৮০ খ্রিস্টাব্দে নির্মিত হয়েছিল বলে ধরে নেয়া হয়।

তাঁতিবাজার পুল: তাঁতিবাজার সেতু সম্পর্কেও তেমন ধারণা পাওয়া যায় না। শিল্পী চার্লস ড’য়লির আঁকা ছবিতে এই সেতুর সুদৃশ্য দেখা মেলে। একটি বিশাল আকৃতির খিলান এর দেখা মেলে। ধারণা করা হয় এমন চারটি খিলান নিয়ে গঠিত ছিল এই সেতু। সেতুর উপরিভাগে রেলিং এ ছোট আকৃতির ছিদ্র দেখা যায়।

টঙ্গী পুল, টঙ্গী-আব্দুল্লাহপুর সড়ক সংলগ্ন।

রেনেল এর ম্যাপ অনুযায়ী, টঙ্গি খালের উপরে নির্মিতব্য টঙ্গি সেতু। ইতিহাস বিখ্যাত “তারিখ-ই-ঢাকা” গ্রন্থে এই টঙ্গি খাল ও সেতু সম্পর্কে উল্ল্যেখ রয়েছে।

[ ॐ श्र:] প্রসিদ্ধ বন্ধু। :א( নূতনরাস্তা—ঢাকা হইতে খামপুর, ফতুল্লা, পাগল হইয় নারায়ণগঞ্জ পর্যন্ত ৮ মাইল বিস্তৃত পাকা রাস্তাটা ইংরেজ গবৰ্ণমেণ্টের ব্যয়ে নিৰ্ম্মিত হইয়াছে, এবং নারায়ণ গঞ্জের অপর তীরবর্তী নবীগঞ্জ নামক স্থান হইতে এই রাস্তাটা পুনরায় আরম্ভ হইয়া কাই কার টেক, ও মোগরা পাড়া হইয়া বৈদ্যেরবাজার পর্য্যন্ত ৭% মাইল প্রসারিত। এই উভয় রাস্তার ধারেই প্রকাগু বৃক্ষাদি রোপিত আছে। ঢাকা হইতে অপর একটা প্রসিদ্ধ রাস্ত টঙ্গী, সিঙ্গছাড়ি, উলুসার হইয়া টোক পৰ্য্যন্ত ৪৬ মাইল বিস্তৃত। এই সুবৃহৎ রাস্তাটা ডিষ্ট্রক্ট ফেরি ফাণ্ডের অর্থানুকুল্যে নিৰ্ম্মিত হইয়াছে। ইঙ্গই ঢাকা জেলার সৰ্ব্ব প্রধান পথ। এই রাস্তার উপরে স্থানে স্থানে পুল আছে। ইতিহাস প্রসিদ্ধ টঙ্গীর পুল এই রাস্তায় পড়িয়াছে। মোগল মুবাদার মীরজুমলা সৰ্ব্ব প্রথম এট রাস্তাটীর পন্তন ও পরিসমাপ্তি করেন বলিয়া অবগত হওয়া যায়। টঙ্গীর পুলটা মীরজুমলার নিৰ্ম্মিত বলিয়া জানা যায় ; কিন্তু কেহ কেহ বলেন সা টঙ্গী নামক জনৈক ফকির নবাব ইব্রান্তিম খণর সময়ে এই পুল প্রস্তুত করিয়াছিলেন। এই রাস্তার একটা শাখা কুদ্ধ হইয়া জয়দেবপুর পর্য্যন্ত ৫মাইল বিস্তৃত। ঢাকা সহব হইতে একটী অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র রাস্ত ১৭• মাইল দূরবর্তী মগবাজার নামক স্থান পৰ্য্যন্ত প্রসারিত । মুন্সীগঞ্জ হইতে একটা ক্ষুদ্র রাস্তা ধলেশ্বরী তীরবর্তী বারুণীঘাট পর্য্যন্ত , মাইল বিস্তৃত । মুন্সীগঞ্জ হইতে অপর একটা রাস্ত ফিরিঙ্গি বাজার, রিকাববাজার, মীর কাদিম, আবদুল্লাপুর, তালতলী, ইছাপুর, সিঙ্গপাড়া হইয় ১৮ মাইল দূরবী শ্ৰীনগর নামক স্থান পৰ্য্যন্ত অগ্রসর হইয়াছে। এই রাস্তাট ১৮৬৬ খ্ৰীষ্টাব্দে আরম্ভ হইয় ৩৪ বৎসরের মধ্যে পরিসমাপ্ত হয়। 

ভারতীয় মুঘল সেতু স্থাপনার ন্যায় এই সেতুতে দুই পাশে ওয়াচ টাওয়ার দেখা যায়। এই ওয়াচ টাওয়ার গুলো সুদীর্ঘ গম্বুজ আকৃতির।

তালতলা পুল: মুঘল আমলের অপর দৃষ্টিনন্দন স্থাপনা তালতলা সেতু সম্পর্কে তেমন তথ্য পাওয়া যায় না। ধারণা অনুযায়ী “মুঘল আমলের এই সেতুটির নির্মাণের ধরণ মীর কাদিম সেতুর ন্যায় ”

ইতিহাস বিখ্যাত “তারিখ-ই-ঢাকা” গ্রন্থে এই তালতলা পুল সম্পর্কে উল্ল্যেখ রয়েছে।

স্থাপত্য বৈশিষ্ট্য :  তালতলা সেতুটিতে তিনটি খিলান রয়েছে; খিলান সমূহ বৃত্তাকার আকৃতির; কেন্দ্রীয় খিলানটি অপেক্ষাকৃত বড় আকৃতির; কেন্দ্রীয় খিলানের স্প্যান অনেক বড়; পার্শ্ববর্তী খিলান দুটি ছোট আকৃতির; পার্শ্ববর্তী খিলানের স্প্যান অনেক ছোট।

বর্তমানে এই সেতুটির হদিস নেই।

মীর কাদিমের পুল, নগর কসবা, ইদ্রাকপুর দূর্গ সংলগ্ন।

কালের আবর্তে টিকে থাকা বহুকালের সাক্ষী মুঘল আমলের আরেক দৃষ্টি নন্দন স্থাপনা ” মিরকাদিম সেতু।”মিরকাদিম সেতুর নির্মাণ কাল ১৬৫৮ থেকে ১৬৬০ সালের মধ্যে। এটির নির্মাতা মীরজুমলা।

সেতুর নাম : :
মিরকাদিমের সেতুর স্থানীয় নাম “পুলঘাটা সেতু”। স্থানীয় লোকজন এই সেতুকে পুলঘাটা সেতু নামেই চেনে, জানে।
মুঘল আমলের সেতুসমূহ

প্রচলিত মিথ বা জনশ্রুতি : :
এই সেতু নিয়ে বহুল জনশ্রুতি প্রচলিত রয়েছে।
• স্থানীয় মিরকাদিমবাসীগণ বিশ্বাস করেন বিখ্যাত এই সেতুটি জ্বীন-পরীদের হাতে তৈরী।
• ধর্মভীরু ও কুসংস্কার আচ্ছন্ন অনেক মানুষের বিশ্বাস এই সেতু কোন মানুষের পক্ষে তৈরী করা সম্ভব না। গায়েবীভাবে এই সেতু তৈরী। কোন এক বৈশাখী পূর্ণিমার রাতে নিজে নিজে তৈরী হয়েছে এই সেতু। অদৃশ্য সত্তা এই সেতু নিজ হাতে গড়ে তোলেন।
• আবার কারো কারো মন্তব্য দেও-দানো ও দৈত্যদের কাজ এইটা। ওদের হাতে তৈরী এক রাতের ফসল এই সেতু।
মিরকাদিমের সেতু নিয়ে যা কিছু প্রচলিত সবই গল্প বৈকি কিছুই নয়। তবুও মিথ বা জনশ্রুতি বেঁচে রয় আজীবন। চিরকাল।
মুঘল আমলের সেতুসমূহ

মিরকাদিম সেতুর ইতিহাস : :
মুঘল আমলে এই বাংলায় মুঘলদের হাত ধরে অনেক সেতু স্থাপনা গড়ে উঠে। সুলতানি আমলে এই বাংলায় সেতু স্থাপনা গড়ে উঠার কোন ইতিহাস পাওয়া যায় না। তেমনি এক উল্ল্যেখযোগ্য নজির মিরকাদিম সেতু।
মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেব এর রাজত্ব কালে ইদ্রাকপুর কেল্লা হতে দোহারে অবস্থিত মুসা খানের কেল্লা পর্যন্ত যোগাযোগ ব্যবস্থা সুদৃঢ় করার জন্যে সুবাদার মীরজুমলা দুইটা সেতু নির্মাণ করেন। তার মধ্যে একটি “মিরকাদিম সেতু”, অপরটি “তালতলা সেতু”।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ইংরেজদের বোমার আঘাতে এই “তালতলা সেতু”টি উড়িয়ে দেয়া হয়। সেতুটি তখনি একেবারে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। যা কিছু অবশিষ্ট ও গল্প সব পাওয়া যায় পুরানো নথি, বই ও ইতিহাসে। আবার লোকেদের মুখে মুখেও এই সেতুর গল্প জানা যায়।
অবশিষ্ট টিকে রইলো মিরকাদিমের সেতু। মিরকাদিম সেতু এখনো অক্ষত আছে।
মিরকাদিম সেতুর গাঠনিক বৈশিষ্ট্য : :
• “মিরকাদিমের সেতু” দেখতে অবিকল সোনারগাঁও এ অবস্থিত “পানাম সেতুর” ন্যায়। তবে পানাম সেতুর চেয়ে ঢাল সহ এই সেতু দৈর্ঘ্যে অনেকটা বড়।
• মিরকাদিমের সেতুর দৈর্ঘ্য ঢাল সহ ১৭২ ফুট, প্রস্থ ১৬ ফুট ৬ ইঞ্চি বিশিষ্ট।
• পানির উপরিভাগ থেকে এই সেতুর উচ্চতা প্রায় ৩০ ফুট।
• ইট নির্মিত এই সেতুর সম্পূর্ণটাই ইটের পলেস্তরা আস্তরণ করা। এই সেতুতে কষ্টি পাথরের কোন অস্তিত্ব নেই।
• সেতুটি বহুল পুরুত্ব বিশিষ্ট। আর পুরুত্ব ১ ফুট ৪ ইঞ্চি।
• সেতুটি ত্রি-খিলানযুক্ত। কেন্দ্রীয় খিলানটি অপেক্ষাকৃত অনেক বড় আকৃতির। এই খিলানের ভিতর দিয়ে এখনো জলযান চলাচল করে।
• বর্ষাকালে সেতুর নীচে জলে কানায় কানায় পরিপূর্ণ থাকে। খরার মরশুমে আবার সেতুর নীচের ভাগ শুষ্ক হয়ে মৃতপ্রায় অবস্থা হয়ে যায়।

হাতিরপুল সেতু, ব্রাক্ষণবাড়িয়া

হাতিরপুল সেতুর নামকরণ : :
হাতিরপুল সেতুর অপর নাম “বাড়িউড়া সেতু”, স্থানীয় লোকজন এই সেতুকে সরাইল সেতু নামেও ডাকে। যার অপর নাম “হাতিরপুল সেতু”।
হাতিরপুল সেতুর অবস্থান : :
কুমিল্লা -সিলেট মহাসড়কে অবস্থিত সরাইল উপজেলার বারিউড়া বাজার। এই বাড়িউড়া বাজার থেকে ১০০ গজ দূরবর্তী পূর্বদিকে রাস্তার বামপাশে এই সেতুটি অবস্থিত।

মুঘল আমলের সেতুসমূহ
হাতিরপুল সেতুর ইতিহাস : :
সরাইল গ্রামের দিওয়ান পরিবারের দ্বিতীয় দেওয়ান মজলিশ শাহবাজ। তিনি তার নিজের নামে শাহবাজপুর গ্রামটি প্রতিষ্ঠা করেন। এই গ্রামের মধ্যে তিনি অনেক উন্নয়নমূলক ও সমাজসেবা মূলক কাজ করেন। দেওয়ান শাহবাজ এই গ্রামে একটি কাঁচারী স্থাপন করেন। তিনি শাহবাজপুর থেকে অপর গ্রাম কুট্টাপাড়া পর্যন্ত একটি সেতু নির্মাণ করেন। স্থানীয়ভাবে এই সেতু জাঙ্গাল নামেও পরিচিত। পরবর্তীতে ১৬৫০ সালে দেওয়ান মজলিশ শাহবাজের পৌত্র ও দেওয়ান নূর মোহাম্মদের পুত্র সরাইলের চতুর্থ দেওয়ান নাসির মাহমুদ হরষপুরে প্রাসাদ, হাম্মামখানা, দূর্গ নির্মান করেন ও যাতায়তের সুবিধার জন্য সড়কটি শাহবাজপুর থেকে হরষপুর পর্যন্ত সম্প্রসারন করেন । এসময়ই হাতিরপুলটি নির্মিত হয়। হাতির পুলের নীচ দিয়ে নৌকা চলাচল করে। পড়ন্ত বিকেলে এলাকার সৌন্দর্য পিপাষু জনসাধারণ এবং পার্শ্ববর্তী এলাকার উৎসাহী দর্শকরাও বিকেলের খানিকটা সময় এখানে কাটিয়ে যান।

হাতিরপুল সেতুর নামকরণ : :
দেওয়ানদের অনেক হাতি ছিল। হাতির পিঠে চড়ে দেওয়ানরা এক স্থান থেকে অপর স্থানে চলাচল করতো। দেওয়ানরা হাতির পিঠে চড়ে এই সেতু দিয়ে যাতায়াত করতো। সেতুর গোড়ায় গেলে হাতিরা ঝিমিয়ে পড়তো। অর্ধ বক্রাকার সেতু পাড়ি দেওয়ার আগে পুলের গোড়ায় হাতি বসে বিশ্রাম নিতো।
হাতিকে কেন্দ্র করে এই সেতু বা পুলের ইতিহাস তাই এই সেতুর নাম – হাতির পুল।
হাতিরপুল সেতুর স্থাপত্য শৈলী : :
• হাতিরপুল সেতুটি ইট নির্মিত।
• এতে কালো ব্যাসল্ট পাথরের কোন অস্তিত্ব নেই।
• হাতিরপুল সেতু এমনভাবে ভেঙ্গেছে যে এর মূল প্রস্থ বা দৈর্ঘ্য জানা অসম্ভব।
• একটি মাত্র খিলান বিশিষ্ট এই সেতু।
• খিলানটির বাইরের অংশে একটি মাত্র প্যানেল সমৃদ্ধ।
হাতিরপুল সেতুর অলংকরণশৈলী: :
যেহেতু হাতিরপুল সেতুটি মুঘল আমলের স্থাপনা সেহেতু এই সেতু তে নান্দনিক সব অলংকরণশৈলী উপস্থিত ছিল। কালের আবর্তে ক্ষয়প্রাপ্ত এই সেতুর অলংকরণশৈলী আজ অনেকটাই ফিকে হয়ে দাঁড়িয়েছে।
হাতিরপুল সেতুর সংরক্ষণ : :
বর্তমানে হাতিরপুল সেতুটি প্রত্নতত্ব অধিদপ্তরের অধিভুক্ত। প্রত্নতত্ব অধিদপ্তর সেতুটি সংস্কার করে সংরক্ষন করেছে। যদিও অতীত আতিসহ্য ও জৌলুশ আর নেই।
হাতিরপুল সেতু কিভাবে যাওয়া যায়:
বাংলাদেশের যে কোন প্রান্ত থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার বিশ্বরোড মোড় এসে সিএনজি যোগে সরাসরি আসা যায়। উপজেলা চত্বর থেকে সিএনজি যোগে যাওয়া যায়।

……….চলবে.………

বিশেষ কৃতজ্ঞতায়  : : প্রতিটা সেতু সার্ভে ও ডকুমেন্টেশন এ সহায়তাকারী : : আফনান প্রান্ত,ছাত্র,সাউথ ইস্ট বিশ্ব বিদ্যালয়, ঢাকা।
বাড়িউড়া সেতুর ছবি প্রদান করে : : জনাব ইবরাহীম,এডমিন: :ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ইতিহাস ও ঐতিহ্য।

পূর্ববর্তী পর্ব

#mughal_bridges #মুঘল_আমলের_সেতুসমূহ #shahriar_mridha_ratul #পানাম_নগর #পানাম_সেতু

One thought on “মুঘল আমলের সেতুসমূহ পর্ব-৩

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *