প্রাচীন জলদুর্গের সন্ধানে water fort

প্রাচীন জলদুর্গের সন্ধানে::গবেষণামূলক প্রকল্প (পর্ব-০২)

প্রাচীন জলদুর্গের সন্ধানে::গবেষণামূলক প্রকল্প (পর্ব-০২)

শাহরিয়ার হাসান মৃধা রাতুল, প্রধান স্থপতি, মৃধা’জ ড্রয়িং হাউজ, নারায়ণগঞ্জ

রেনেলের ম্যাপ অনুযায়ী জলদুর্গের অবস্থান

প্রাচীন জলদুর্গের সন্ধানে ম্যাপের উৎস জানতে জেমস রেনেল এর ভূমিকা অনস্বীকার্য।

জেমস রেনেল। রেনেলের দুর্গ স্থাপনার ম্যাপ। (সৌজন্যে- ধ্রুব আলম, ট্রান্সপোর্ট প্ল্যানার )
প্রাচীন জলদুর্গের সন্ধানে
রেনেল কর্তৃক প্রণীত দুর্গ স্থাপনার ম্যাপ এর একাংশ।

মহাসমুদ্রাবিদ্যার জনক জেমস রেনেল (১৭৪২ খ্রিষ্টাব্দ – ১৮৩০ খ্রিষ্টাব্দ) পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ জাহাজে করে ঘুরে বেড়িয়েছেন। উনার জীবনযাত্রা ছিল অনেকটা “আরব্য রজনী”র “সিন্দবাদ” এর মতো। তিনি নদীয়া জেলার উত্তর সীমান্তবর্তী জলঙ্গি নদীর মাথা থেকে পূর্বদিকে ঢাকা পর্যন্ত গঙ্গা ও পদ্মার দক্ষিণ তীর তথা অববাহিকাবর্তী নদীনালা জরিপের লক্ষ্যে আমিন হিসেবে নিযুক্ত হয়েছিলেন।

রেনেলের ম্যাপ অনুযায়ী প্রাপ্ত দুর্গের একটা সরলরৈখিক পথ তৈরী হয়। যেটা ইদ্রাকপুর দুর্গ থেকে শুরু করে ধাপে ধাপে বেগ মুরাদের দুর্গ হয়ে ঢাকা পর্যন্ত বিস্তৃত। প্রতিটা দুর্গে কামানের ব্যবস্থা থাকবে। সেই ড্রাম থেকে কামানের গোলা ছোড়া হবে। এতগুলো প্রতিরক্ষা প্রাচীরের ধাপ পেরিয়ে ঢাকা পৌঁছানো একেবারেই অসম্ভব ব্যাপার। মুঘলদের এই প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সত্যিই চমকপ্রদ ও সুদৃঢ় এক ব্যবস্থা।

রেনেলের ম্যাপ অনুযায়ী,প্রাপ্ত দুর্গ সমূহের নাম

  • * ইদ্রাকপুর দুর্গ,ইদ্রাকপুর,মুন্সীগঞ্জ সদর(প্রাচীন বিক্রমপুর)
  • * সোনাকান্দা দুর্গ(সুবর্ণকান্দি দুর্গ),সোনাকান্দা(প্রাচীন সুবর্ণকান্দি),বন্দর,নারায়ণগঞ্জ
  • * হাজীগঞ্জ দুর্গ,হাজীগঞ্জ(প্রাচীন খিজিরপুর),নারায়ণগঞ্জ
  • * দাপা দুর্গ,দাপা,ফতুল্লা,নারায়ণগঞ্জ
  • * ফতুল্লা দুর্গ(অনেকের মতে, নাম নেই),ফতুল্লা,নারায়ণগঞ্জ
  • * বেগ মুরাদের দুর্গ,পাগলা,নারায়ণগঞ্জ
  • * অষ্টভুজাকার মোগলাই চর

রেনেল এর ম্যাপ অনুযায়ী স্বল্প সংখ্যক দুর্গের নাম ও অবস্থান উঠে আসলেও বাস্তবে আরো দুর্গের নাম ও অবস্থান ছিল। সেসব দুর্গ স্থাপনা সম্পর্কে অনেক নথি,দলিল-দস্তাবেজ,পুস্তক ও পুঁথিতে লেখা আছে কম-বেশি।

সামগ্রিক দিক বিবেচনায় প্রাপ্ত দুর্গের তালিকা  : :

  • * ইদ্রাকপুর দুর্গ,ইদ্রাকপুর,মুন্সীগঞ্জ সদর(প্রাচীন বিক্রমপুর)
  • * কলাগাছিয়া দুর্গ,মদনগঞ্জ,বন্দর,নারায়ণগঞ্জ
  • * সোনাকান্দা দুর্গ(সুবর্ণকান্দি দুর্গ),সোনাকান্দা(প্রাচীন সুবর্ণকান্দি),বন্দর,নারায়ণগঞ্জ
  • * হাজীগঞ্জ দুর্গ (খিজিরপুর দুর্গ),হাজীগঞ্জ(প্রাচীন খিজিরপুর)নারায়ণগঞ্জ
  • * দাপা দুর্গ,দাপা,ফতুল্লা,নারায়ণগঞ্জ
  • * ফতুল্লা দুর্গ(অনেকের মতে, নাম নেই),ফতুল্লা,নারায়ণগঞ্জ
  • * বেগ মুরাদের দুর্গ,পাগলা,নারায়ণগঞ্জ
  • * নাম না জানা দুর্গ,গেন্ডারিয়া,ঢাকা (প্রাচীন জাহাঙ্গীর নগর)
  • * জিঞ্জিরার দুর্গ,কেরানীগঞ্জ,ঢাকা (প্রাচীন জাহাঙ্গীর নগর)
  • * সর্বশেষ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, লালবাগ দুর্গ সমেত

জলদুর্গের সীমানা

  • প্রথমত

    ,ইদ্রাকপুর দুর্গ,ইদ্রাকপুর,মুন্সীগঞ্জ সদর(প্রাচীন বিক্রমপুর)

চট্টগ্রাম থেকে জলদস্যুদের নৌযোগে মেঘনা নদীতে আগমন। মেঘনা নদী অতিক্রম করে ইছামতী নদীর সঙ্গমস্থলে এসে পৌঁছানোর প্রাক্বালে বিক্রমপুরের ইদ্রাকপুর এ অবস্থিত “ইদ্রাকপুর দুর্গ ” থেকে কামানের গোলা বর্ষণ ও জলদস্যু নিপাত। যদি এই পথ অতিক্রম করা হয় –

  • দ্বিতীয়ত,

    কলাগাছিয়া দুর্গ,মদনগঞ্জ,বন্দর,নারায়ণগঞ্জ

ইছামতী অতিক্রম করে শীতলক্ষ্যা নদীর সঙ্গমস্থলে এসে পৌঁছানোর প্রাক্বালে কলাগাছিয়াতে অবস্থিত “কলাগাছিয়া দুর্গ” থেকে কামানের গোলা বর্ষণ ও জলদস্যু নিপাত। যদি এই পথ অতিক্রম করা হয়।

  • তৃতীয়ত,

    সোনাকান্দা দুর্গ(সুবর্ণকান্দি দুর্গ),সোনাকান্দা(প্রাচীন সুবর্ণকান্দি),বন্দর নারায়ণগঞ্জ

শীতলক্ষ্যা নদী অতিক্রমকালে মধ্যিভাগে সোনাকান্দায় অবস্থিত “সোনাকান্দা দুর্গ” থেকে কামানের গোলা বর্ষণ ও জলদস্যু নিপাত। যদি এই পথ অতিক্রম করা হয়।

  • চতুর্থত,

    হাজীগঞ্জ দুর্গ (খিজিরপুর দুর্গ),হাজীগঞ্জ(প্রাচীন খিজিরপুর)নারায়ণগঞ্জ

শীতলক্ষ্যা নদী অতিক্রম করে বুড়িগঙ্গা নদীর সঙ্গমস্থলে এসে পৌঁছানোর প্রাক্বালে খিজিরপুরে (বর্তমান হাজীগঞ্জ) অবস্থিত খিজিরপুর দুর্গ বা, হাজীগঞ্জ দুর্গ থেকে কামানের গোলা বর্ষণ ও জলদস্যু নিপাত। যদি এই পথ অতিক্রম করা হয়।

  • পঞ্চমত

    ,দাপা দুর্গ,দাপা,ফতুল্লা,নারায়ণগঞ্জ

বুড়িগঙ্গা নদী অতিক্রমকালে মধ্যিভাগে ফতুল্লায় অবস্থিত “দাপা দুর্গ” থেকে কামানের গোলা বর্ষণ ও জলদস্যু নিপাত। যদি এই পথ অতিক্রম করা হয়।

  • ষষ্ঠত

    , ফতুল্লা দুর্গ(অনেকের মতে, নাম নেই),ফতুল্লা,নারায়ণগঞ্জ

“দাপা” দুর্গের পশ্চিমদিকে নাম না জানা দুর্গটিও একই সময়ে একই ভূমিকা রাখতো।

  • সপ্তমত

    , বেগ মুরাদের দুর্গ,পাগলা,নারায়ণগঞ্জ

বুড়িগঙ্গা নদী অতিক্রম করে দোলাই নদীর সঙ্গমস্থলে এসে পৌঁছানোর প্রাক্বালে পাগলাতে অবস্থিত “বেগ মুরাদের দুর্গ” থেকে কামানের গোলা বর্ষণ ও জলদস্যু নিপাত। যদি এই পথ অতিক্রম করা হয়।

  • অষ্টমত

    , নাম না জানা দুর্গ,গেন্ডারিয়া,ঢাকা (প্রাচীন জাহাঙ্গীর নগর)

“বেগ মুরাদের দুর্গে”র পাশাপাশি নাম না জানা দুর্গটিও একই সময়ে একই ভূমিকা রাখতো।

  • নবমত

    , জিঞ্জিরার দুর্গ,কেরানীগঞ্জ,ঢাকা (প্রাচীন জাহাঙ্গীর নগর)

বুড়িগঙ্গা নদী অতিক্রমকালে মধ্যিভাগে কেরানীগঞ্জে অবস্থিত “জিঞ্জিরার দুর্গ “থেকে কামানের গোলা বর্ষণ ও জলদস্যু নিপাত। যদি এই পথ অতিক্রম করা হয় তবেই ঢাকা। জিঞ্জিরার দুর্গ কেন্দ্রীয় কারাগার সংলগ্ন স্থাপনা। এটিকে রাজধানী ঢাকার সর্বশেষ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা বলে ধরা হয়।

  • সর্বশেষ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা

সর্বশেষ দুর্গ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার সবকটা দুর্গ পাড় হলে আমরা পাই “লালবাগ দুর্গ”। যুবরাজ মুহম্মদ আজম  তার শাসনামলে ১৬৭৮ খ্রিষ্টাব্দে এই দুর্গের নির্মাণ কাজ শুরু করেন। এই দুর্গের  নির্মাণ কাজ শেষ হওয়ার আগেই সম্রাট আওরঙ্গজেব তাঁকে দিল্লিতে ডেকে পাঠান। পরবর্তীতে, সুবাদার শায়েস্তা খান (১৬০০ খ্রিষ্টাব্দ-১৬৯৪ খ্রিষ্টাব্দ) ১৬৮৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ঢাকায় অবস্থান করলেও দুর্গের কাজ শেষ করতে পারেন নি। ১৬৮৪ খ্রিস্টাব্দে শায়েস্তা খানের কন্যা বিবি পরী এখানে মারা গেলে দুর্গটিকে তিনি অপয়া হিসেবে বিবেচনা করে এর নির্মাণ কাজ বন্ধ করে দেন। এই দুর্গের অভ্যন্তরেই তার কন্যাকে সমাধিস্থ করা হয়।  সুবাদার শায়েস্তা খানের অপর কন্যা “বিবি মরিয়ম” (তুরান দখত) কে নারায়ণঞ্জের খিজিরপুরে বিয়ে দিয়েছিলেন। তার মৃত্যুর পরে তাকে খিজিরপুর দুর্গ সংলগ্ন স্থানে সমাহিত করেন। যেটি বর্তমানে নারায়ণগঞ্জে, বিবি মরিয়মের সমাধি ও মসজিদ নামে সমধিক পরিচিত।

সতেরো শতকের শেষ দিকে, সুবা বাংলার রাজধানী ঢাকায় প্রাসাদ দুর্গ হিসেবে লালবাগে আরো একটি দুর্গ নির্মাণের কাজ আরম্ভ হলেও সে দুর্গের কাজ বন্ধ হয়ে যায়। অচিরেই পরিত্যক্ত ভিটায় রূপান্তরিত হয় এই দুর্গ। নচেৎ এই দুর্গ টি সম্পূর্ণরূপে তৈরী হলে, মুঘল ঢাকার প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার সুদৃঢ় কাঠামোর এক ভিত্তি হতো।

মুঘল আমলের পূর্ববর্তী নমুনার স্বাক্ষর (ব্যতিক্রম)

হাজীগঞ্জ দুর্গের সঠিক ইতিহাস ও নির্মাণকাল নির্ণয়ে অকাট্য দলিল : : দলিল-বাহারীস্থান-ই-গায়েবী

হাজীগঞ্জ দুর্গ,  সম্পর্কে কিছুটা ব্যতিক্রম ঘটে। হাজীগঞ্জ দুর্গ মুঘলদের অধিনস্তে আসে। ভাঙ্গা-চূড়া দুর্গের মেরামত করা হয়। মুঘল ঢাকার প্রতিরক্ষা ব্যবস্থামূলক সরলরৈখিক জলদুর্গের সাথে একেও সংযুক্ত করা হয়। এই জলদুর্গকে ঘিরে একটি বৃহৎ দুর্গ মুঘল আমলের পূর্ববর্তী সময়ে ছিল বলে কিছু তথ্য-উপাত্ত মেলে।

তায়েশ, আবদুল করিম, সৈয়দ মাহমুদুল হাসান তাদের মতানুযায়ী এই জলদুর্গের নির্মাতা হলেন মীর জুমলা। আবার, অধ্যাপক দানী, সৈয়দ মোহাম্মদ তৈফুর এই জলদুর্গের নির্মাতা মীর জুমলাকে স্বীকার করেন না।  আপাত দৃষ্টিতে তথ্যের অপ্রতুলতা এই জলদুর্গের নির্মাণকাল নির্ণয়ে বাধা সৃষ্টি করছে। সেক্ষত্রে একটি অকাট্য দলিল হলো, ঐতিহাসিক গ্রন্থ “বাহারীস্থান-ই-গায়েবী” ও “আকবর নামা”য় বেশ কিছু তথ্য ও ঘটনার প্রমান মেলে। মুঘল সেনাপতি মীর্জা নাথান এর লিখা “বাহারীস্থান-ই-গায়েবী” গ্রন্থ। তাই এই গ্রন্থের মর্যাদা ই আলাদা। “বাহারীস্থান-ই-গায়েবী” গ্রন্থে রয়েছে যা তা হুবহু তুলে ধরা হলো।

“ইসলাম খাঁ ইহতিমাম খাঁকে কয়েক লাইন চিঠি লিখেন। রাত্রির শেষ প্রহরে চিঠি তাঁর কাছে পৌছে। ইহতিমাম খাঁকে সেখানে অবস্থান করতে আর শেখ কামাল ও মির্জা নাথানকে খিজিরপুর এবং কুমারসরে এগিয়ে যেতে নির্দেশ দেন। এ দুটি স্থানের যে কোন একটি শেখ কামালের জন্য ছেড়ে দিতে মির্জা নাথানকে উপদেশ দেন। তদানুযায়ী মির্জা নাথান শেখ কামালসহ এক বড় স্থল ও নৌবাহিনী নিয়ে রওনা হন। প্রথমদিন কোপার মোহনায় অবস্থান করেন। রাত প্রভাতের চার ঘড়ি পূর্বে তারা লক্ষা নদীর তীর পর্যন্ত অগ্রসর হন। সকাল বেলা মির্জা নাথান খিজিরপুর আর শেখ কামাল কুমারসরে পৌঁছেন। সেখানে তারা দুর্গ তৈরী শুরু করেন। শত্রুরা তাদের নৌবাহিনী নিয়ে যুদ্ধ করতে আসে এবং কামান ছুঁড়তে আরম্ভ করে। শাহী বাহিনী তাদের দুর্গ তৈরির কাজ শেষ করতে না পারলেও যেখানেই উঁচু স্থান পেয়েছেন, সেখান থেকেই তাঁরা তাদের বড় কামান ছুঁড়ে শত্রুদেরকে নৌকা থেকে নদীতে ফেলতে থাকেন। কামানের গোলার ঘায়ে বড় কোষা নৌকাগুলো তাদের আরোহীসহ নদীর জলে ডুবে যায়। নদীর তীরে মির্জা নাথান যে দুর্গ তৈরী শুরু করেছিলেন তা দিনের শেষের দিকে সম্পন্ন হয়।  বিভিন্ন স্থানে কামান সাজিয়ে মীর্জা নাথান তার অধীনস্থ কর্মচারীদের নিয়োগ করেন। দোলাই এবং লক্ষ্যা নদীর সঙ্গমস্থলে অবস্থিত খিজিরপুরের মোহনায় মোহাম্মদ খা পনিকে পাঁচশো অশ্বারোহীসহ নিয়োজিত করেন। গোলন্দাজ বাহিনীর কাটারী এবং মানিকী নৌকা দ্বারা নদীর মুখে একটি সেতু নির্মাণ করেন। এর বামপাশে পঞ্চাশ জন সৈন্যসহ শাহবাজ খাঁ  বারিজকে পরিখায় অবস্থান করতে দেন।তাদের বামে চল্লিশজন ঘোড় সওয়ারসহ শেখ সোলেমান উসমানীকে নিয়োজিত করেন। এদের পিছনে ইলাদাদ খাঁ কাসী ও সত্তরজন অশ্বারোহী নিয়োজিত করেন।

ইলাদাদ খাঁর পিছনে পর পর কয়েক লাইনে নব্বই জন সৈন্যসহ শেখ চামরু বখ্তিয়ার, একশো চল্লিশ জন সৈন্য সহ  উলুবাবা খাঁর পুত্র ফতেজঙ্গ এবং দুশ অশ্বারোহীসহ আঁকা নোমান বখশী কে নিয়োজিত করেন। মির্জা নাথান এক বড় অনিয়মিত বাহিনী নিয়ে খিজিরপুরের মসজিদে তার সদর দপ্তর স্থাপন করেন। কামানের গোলার বাইরে তিনি তার পিলখানা (হাতীশালা) স্থাপন করেন। শেখ কামাল কুমারসরে তার প্রথম দুর্গ তৈরী করেন। নদীর তীর পর্যন্ত তিনি অগ্রসৰ হতে সমর্থ হননি। দ্বিতীয় দিন তিনি মাঝখানে আরো একটি প্রাচীর তৈরী করেন এবং পরে নদী তীরে তৃতীয় বুরুজ তৈরী করেন।“

“বাহারীস্থান-ই-গায়েবী”

থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, “বাহারীস্থান-ই-গায়েবী” গ্রন্থ থেকে সুস্পষ্টভাবে একটি বিষয় নির্ধারণ করা যায় যে, হাজীগঞ্জ দুর্গটি’ই খিজিরপুর দুর্গ যা শীতলক্ষ্যা নদীর তীরবর্তী।

হাজীগঞ্জ দুর্গের নির্মাণকাল সম্বন্ধে আরেকটি নির্ভরযোগ্য তথ্যসূত্র হলো আকবরনামা। আকবরনামা অনুসারে, খিজিরপুরের (হাজীগঞ্জের কাছে পুরাতন বুড়িগঙ্গার তীরে সামরিক ছাউনি তৈরী হওয়ার পূর্ব থেকেই নদীর পার্শ্বে যাতায়তের মধ্যবর্তী সরাসরি পথ যার দুইদিক উন্মুক্ত) অবস্থানগত সুবিধার জন্য দুটি শক্তিশালী দুর্গের অস্তিত্ব ছিল। উভয় দুর্গই কম সময়ের মধ্যে মোগলেরা অধিকার করে নেয়।

আকবরনামা থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, এই বাংলায় মুঘল শাসনামল প্রতিষ্ঠার আগেই খিজিরপুরে (হাজীগঞ্জ) ও নদীর ওপার কত্রাভু’তে (নবীগঞ্জ) দুর্গ ছিল। কত্রাভু ছিল মুসা খানের রাজধানী।

খিজিরপুর দুর্গ যে অনেক প্রাচীন তার প্রাচীনত্বের প্রমান স্বরূপ একটি সি এস  ম্যাপ পাওয়া গেছে । ব্রিটিশ আমলের এই  সি এস  ম্যাপ এ বর্তমান হাজীগঞ্জ দুর্গের নকশার চারিপার্শ্বে আরো কিছু প্রতিরক্ষা প্রাচীর ও নকশার দেখা মেলে। বলা চলে, বর্তমানে যে জলদুর্গের প্ল্যান বা নকশা দেখা যায়, তা ওই দুর্গের বৃহৎ নকশার তুলনায় নিতান্তই ছাড়। ব্রিটিশ আমলে ঐতিহাসিক নারায়ণগঞ্জ নগরীতে একবার ভূমি জরিপ হয়েছিল। সেই জরিপ অনুযায়ী, হাজীগঞ্জের মৌজায় দুর্গের স্থলে একটি বৃহৎ দুর্গের সন্ধান মেলে। সমগ্র স্থাপনাটি প্রায় ২৫ একর ভূমির উপরে ছিল বলে জানা যায়।

প্রাচীন জলদুর্গ বনাম ঈশা খাঁর জলদুর্গ

ঐতিহাসিক জলদুর্গের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে আরো এক ব্যক্তির নাম।  তিনি হলেন, বাংলার বারো ভূঁইয়াদের একজন ঈশা খাঁ। ঈশা খাঁকে ঘিরে এই জলদুর্গের যে ঘটনা বা গল্প জনশ্রুতি বা মিথ হলেও অনেক ঐতিহাসিকগণ আবার তাকে স্বীকার করেন।  অধ্যাপক স্বরূপ চন্দ্র রায় তার রচিত “সুবর্ণ গ্রামের ইতিহাস” গ্রন্থে উল্ল্যেখ করেছেন যে, ঈশা খান ত্রিবেণী,হাজীগঞ্জ,কলাগাছিয়ার মুখে ও অন্যান্য স্থানে নতুন দুর্গ নির্মাণ করেন। জানি না, কি এক অজানা কারণে বাংলার বেশিরভাগ পৌরাণিক স্থাপত্যের সাথে ঈশা খাঁর নাম জুড়ে রয়েছে। যেদিকে যা কিছু দেখা যাবে তাই ঈশা খাঁর নির্মাণ। তবে অনেকের মতে, মুঘল বিরোধী ঈশা খান যুদ্ধের মাধ্যমে মুঘলদের কাছ থেকে এই জলদুর্গ অধিকার করেছিলেন। পরবর্তীতে এই দুর্গের পুনঃনির্মান সহ উন্নয়ন করেন।

নিখিলনাথ রায় এর ঐতিহাসিক চিত্র (তৃতীয় বর্ষ) এর ১৮ নং পাতা অবলম্বনে – সিংহকে চমকিত করিলেন। কিন্তু এবার তঁহাকে পরাস্ত হইতে হইল। কথিত আছে যে, মানসিংহ ঠাহাকে আবার তাহার রাজ্য পুনঃপ্রদান করিয়াছিলেন । এই সময়ে কেদার রায়ের কুলদেবতা শিলামাতাকে মানসিংহ লইয়া যান। শিলামাতা অন্যাপি জয়পুররাজ্যের প্রাচীন রাজধানী অম্বর নগরে অবস্থিতি করিতেছেন। — কেদার রায় পর্যাপদ ঠাইয়া মানসিংহের বশ্যতা স্বীকার করিয়াছিলেন বটে, কিন্তু একে বাবে স্বাধীন তা পরিত্যাগ করেন নাই । মানসিংহ তাহাকে তাহার রাজ্যে স্থাপিত করিয়াছিলেন। ক্ৰমে কেদার রায় আবার সম্পূর্ণ স্বাধীনতা, ঘোষণা করেন । এই সময়ে আরাকানরাজ সেলিম সা ও আপনার গোলন্দাজ সেনা ও রণতরী লইয়া বাঙ্গলা আক্রমণের জন্য অগ্রসর হন । কিন্তু তিনি কোদাল রায়ের পর ৫ম বিশেষ ভাবে অবগত ছিলেন । কেদার রায়ের সহিত সংঘর্ষ উপস্থিত হইলে তিনি যে কৃতকার্স্য হইতে পরিবেন না, তাহাও তেঁাহার অবিদিত ছিল না, সেই জন্য তিনি কেদার রায়ের সহিত মিলিত হইয়া পূর্ববঙ্গের অন্যান্য স্থান অধিকারের জন্য ইচ্ছা প্ৰকাশ করেন । কেদার রায় দুষ্ঠাখার পস্তাবে সন্মত হইলে, উভয়ে মিলিত হইয়া অনেক স্থান মোগলদিগের হস্ত হইতে বিচ্ছিন্ন করিয়া লন। ইহার পূৰ্ব্বে ইশা খাঁর মৃত্যু হওয়ায় সোনারগাঁও আ ক্ৰমণ কালে ‘সাদ রায়ের কন্যা স্বর্ণময়ী বা সোনাবিবি কেদার রায় ও মগদিগের সহিত ঘোরতর সাক্ষা করিয়াছিলেন । কেদার লজ্জায় ও ক্ষোভে সোনারগা পানি ত্যাগ করিয়া চলিয়া আসেন । মোগলসৈন্যেরা তাহাদের মগরাজের অধীনে আইসে। আবার পূর্ববঙ্গে অশান্তির আগুন প্ৰজ্বলিত হইয়া উঠিলে মানসিংহ।

প্রাচীন জলদুর্গের ব্যবহার

প্রাচীন এই জলদুর্গ বহুমুখী কাজে ব্যবহৃত হতো। দেখা গেছে, এই মুঘল স্থাপনা মুঘল রাজা বাদশাহদের রাজ্য পরিচালনার কাজে ব্যবহার করতো। আবার এই আমুদে স্থাপনা তাদের মনোরঞ্জনের কাজেও ব্যবহার করা হতো। জলদুর্গ মূলত যুদ্ধক্ষেত্ৰ। এখান থেকে রাজা বাদশাহরা যুদ্ধ পরিচালনা করতো আবার মগ ও পর্তুগিজ জলদস্যুদের প্রতিহত করার জন্যে কামান গোলা বর্ষণ করতো। এক-একটি রাজ্য সুরক্ষার জন্যে এই জলদুর্গ। প্রতিটা জলদুর্গকে ঘিরে রয়েছে এক একটি মর্মস্পর্শী ও হৃদয়বিদারক ঘটনা বা কাহিনী। তবে এই মর্মদন্তু কাহিনীগুলোকে এড়ানো সম্ভব নয়। কোন কোন ক্ষেত্রে এক- একটি জনশ্রুতি বা মিথ বলিষ্ঠ উদাহরণ। জনশ্রুতিতে উল্ল্যেখিত,ঘটনা রাজি,রাজা-রানী,বাদশাহ-সম্রাজ্ঞী,রাজপুত্র-রাজবধূ, রাজকন্যা-রাজ্ জামাতা এক একটা জীবন্ত চরিত্র ও দৃষ্টান্ত।তাদের সবাইকে কেন্দ্র করে যে গল্প বা উপাখ্যান তা সত্যিকার অর্থেই বাস্তবিক ও প্রাণবন্ত।

বর্তমানে এই জলদুর্গের অবস্থা

বর্তমানে তিনটি মাত্র জলদুর্গ টিকে রয়েছে। যথাক্রমে -ইদ্রাকপুর দুর্গ, সোনাকান্দা দুর্গ, হাজীগঞ্জ দুর্গ। জলদুর্গ স্থাপনার বেশ’কটা কালের করালগ্রাসে ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে চিরতরে হারিয়ে গেছে।

আবার কোন কোনটি নদীভাঙনের শিকার। যেমন – কলাগাছিয়া দুর্গ। ১৯৭১ সালের যুদ্ধপরবর্তী সময় পর্যন্ত ও এই কলাগাছিয়া দুর্গের ধ্বংসাবশেষ টিকে ছিল। যা স্থানীয় লোকেদের মুখে মুখে এখনো গল্প আকারে রয়ে গেছে। যারা স্ব-চক্ষে দেখেছেন তাদের অনেকেই এখনো বেঁচে আছেন। তাদের মুখে মুখে শোনা যায় এই জলদুর্গের গল্প। বর্তমানে এই জলদুর্গের অবশেষ চিহ্নটুকু ও নেই। আবার নদীর গতিপথ পরিবর্তনের সময় চিরকালের জন্যে হারিয়ে যায় দাপা দুর্গ ও পাগলা দুর্গের ধংসাবশেষ।

তিনটি দুর্গ ভঙ্গুর ও জীর্ণ-শীর্ণ অবস্থায় পরে আছে। কোথাও কোথাও এক আধটু ভেঙে পড়েছে আবার কোথাও বা পলেস্তরা খসে পড়েছে। দুর্গের উপরিভাগের মার্লনের অবস্থা বড়োই নাজুক অবস্থায় রয়েছে। দুর্গের প্রধান তোরণদ্বারে এক সময় বহু অলংকরণ এর দেখা মিলতো। সেসব এর বালাই এখন আর নাই। এক একটি জলদুর্গ যেন পরিত্যক্ত ভিটে। এইসব স্থাপনা টিকে রয়েছে কালের স্রোতের গা ভাসিয়ে। প্রাকৃতিক বৈরীর হাত থেকে এসব স্থাপনা কোনভাবে রক্ষা পেলেও কতিপয় স্থাপনার শেষ রক্ষা হয় না মানুষের হাত থেকে।

প্রাচীন জলদুর্গের সন্ধানে
সোনাকান্দা দুর্গের বিভিন্ন অংশ। বা থেকে, কামান স্থাপনার বৃত্তীয় মঞ্চ, দুর্গের অভ্যন্তরভাগ, বুরুজ।
প্রাচীন জলদুর্গের সন্ধানে হাজীগঞ্জ দুর্গের বিভিন্ন অংশ
হাজীগঞ্জ দুর্গের বিভিন্ন অংশ। বা থেকে, কামান স্থাপনার মঞ্চ বুরুজ, অভ্যন্তরীণ পর্যবেক্ষণ বুরুজ, দুর্গ স্থাপনার প্রাচীর।

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

প্রাচীন জলদুর্গের সন্ধানে
ইদ্রাকপুর দুর্গের বিভিন্ন অংশ। বা থেকে, কামান স্থাপনার মঞ্চ, মঞ্চে প্রবিষ্ট ত্বোরণ দ্বার, দুর্গের অভ্যন্তরীণ অংশ।

সময়ের এফোঁড়-ওফোঁড় পেরিয়ে প্রাকৃতিক বৈরী জলবায়ু ও আদ্র আবহাওয়ায় বেশ কটা দুর্গ টিকে থাকলেও নিষ্কৃতি মেলেনি মানুষের বিচিত্র মনের খেয়াল থেকে। মানুষের মনমানসিকতা, নিদারুন চাওয়া-পাওয়া ও দৃষ্টিভঙ্গির প্রসারণের কারণে এই দুর্গ স্থাপনার অনেক পরিবর্তন ঘটেছে।

মানুষ নিজে প্রকৃতির মূল্যবোধ দিতে জানে না বলে প্রকৃতি মানুষের সাথে বৈরী আচরণ করে তার বিদ্রোহ প্রকাশ করে নিরন্তর!

—–চলবে—-(পরবর্তী পর্বের জন্য চোখ রাখুন আমাদের ওয়েব সাইট ও ফেসবুক পেজ এ)

আগের পর্বের লিংকঃঃ গবেষণামূলক প্রকল্প :: প্রাচীন জলদুর্গের সন্ধানে (পর্ব-০১)

Contact No :: 01873461322, Gmail :: godhulylogonee@gmail.com

2 thoughts on “প্রাচীন জলদুর্গের সন্ধানে::গবেষণামূলক প্রকল্প (পর্ব-০২)

Comments are closed.