পার্বত্য ইকো রিসোর্ট Eco Resort ও অবহেলিত অগ্নি নিরাপত্তা-প্রসঙ্গ সাজেক ভ্যালী
পার্বত্য ইকো রিসোর্ট Eco Resort ও অবহেলিত অগ্নি নিরাপত্তা-প্রসঙ্গ সাজেক ভ্যালী
ইদানিং বহুল চর্চিত একটি ধারনা হচ্ছে Sustainable Development বা টেকসই উন্নয়ন; যা নির্মাণশিল্প থেকে শুরু করে বানিজ্যিক উন্নয়ন, সামাজিক নিরাপত্তাসহ সব কিছুতেই প্রভাব বিস্তার করছে। এরই প্রেক্ষিতে অধুনা Eco Friendly বা পরিবেশ বান্ধব স্থাপনা নির্মানের ঝোঁক তৈরী হয়েছে। বিশেষ করে রিসোর্ট সেন্টার, কটেজ, রেস্তোরাঁ বা সরাইখানাসহ পর্যটন শিল্পের সাথে জড়িত বিভিন্ন স্থাপনার ক্ষেত্রে এমনটি বেশি পরিলক্ষিত হয়। পরিবেশ বান্ধব নির্মাণের মনোবাঞ্ছা থেকে এসব স্থাপনা নির্মাণের চল শুরু হলেও আমাদের দেশে পর্যটন শিল্পের বিকাশের সাথে সাথে অধিক পর্যটক আকর্ষণের নিমিত্তে এ খাতের উদ্যোক্তারা ইকো রিসোর্ট Eco Resort নির্মাণের দিকে ঝুঁকে পড়েছেন। অন্যদিকে পর্যটন শিল্পের ক্রমবিকাশের ধারাবাহিকতায় আমাদের দেশের নৈসর্গিক পার্বত্য অঞ্চলে কাঠ/বাঁশ/ছন বা প্রাকৃতিক উপকরণে নির্মিত পর্যটনকেন্দ্রের বেশ প্রভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
কিন্তু শংকার বিষয় হচ্ছে এখানে নির্মিত পরিবেশ সম্পর্কে আমরা আসলে কতটা সচেতন বা ওয়াকিবহাল। এসবের নির্মাণ মান বা সার্বিক নিরাপত্তা ও সুরক্ষা নিয়েও যথেষ্ট পর্যালোচনার প্রয়োজন রয়েছে।
কংক্রীটের জঙ্গল থেকে পালিয়ে সোঁদা মাটির অরণ্য, পাহাড়, প্রপাত, মেঘ আর প্রকৃতি উপভোগ করতে গিয়েছিলাম খাগড়াছড়ি হয়ে রাঙামাটির বাঘাইছড়ি উপজেলার সাজেক ভ্যালীতে। সেখানে যা দৃষ্টিগোচর হয়েছিল তাতে দু/একটি বাদে এ অঞ্চলের নির্মিত পর্যটনকেন্দ্রগুলো বস্তুত কাঠ বা বাঁশের তৈরি যার ছাদ নির্মিত হচ্ছে ছন বা টিন দিয়ে। পরিবেশবান্ধবতার নামে এবং পর্যটকদের প্রকৃতির স্বাদ দিতে এসব তৈরি করা হলেও মূলত দ্রুততম সময়ে এবং নির্মাণের খরচ ও ঝক্কি কমাতেই উদ্যোক্তারা প্রাকৃতিক উপাদান দিয়ে এসব রিসোর্ট বানাচ্ছেন। এখানে নেই কোন মান নিয়ন্ত্রনের বালাই। এ ধরনের পর্যটনকেন্দ্র নির্মাণে যে দক্ষতা, পূর্বসতর্কতা ও স্থাপত্য প্রযুক্তি প্রয়োগের প্রয়োজন সেসবের অনেক কিছুই আমলে না নিয়েই অপরিকল্পিতভাবে এখানে স্থাপনাগুলো নির্মিত হচ্ছে।

সরেজমিনে সাজেকেঃ
সরেজমিনে দেখা যায়, কাঠ বা বাঁশ দিয়ে নির্মিত বেশ কয়টি রিসোর্টের প্রাইভেসি বা নির্জনতা নিশ্চিতের নেই কোন ব্যবস্থা। কাঠের তক্তা জোড়া দিয়ে বানানো দেয়ালে যথেষ্ঠ ছিদ্র/ফাঁক থাকার কারনে এক কক্ষের শব্দ যেমন পাশের কক্ষের অতিথিদের বিরক্তির কারন হচ্ছে তেমনিভাবে কক্ষের পর্যটকদের ব্যক্তিগত গোপনীয়তাও লংঘিত হচ্ছে। শব্দ কমানোর জন্য দেয়ালের অভ্যন্তরীণ আবরণের ব্যবহার এখানে অনুপস্থিত। এখানে যে বৈদ্যুতিক ওয়্যারিং করা হচ্ছে সেগুলো উন্মুক্তভাবেই কাঠ/বাঁশ/ছনের মতো অগ্নিসংবেদনশীল নির্মাণ সামগ্রীর সাথে শুধু ক্লিপিং করে সম্পন্ন করা হয়েছে। স্থাপিত তারগুলোতে পৃথকীকরণ নিরোধক স্তর না থাকার কারণে শর্ট সার্কিট হলে মুহুর্তেই আগুন ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা থাকছে মুল স্থাপনায়। তদোপরি এসব সংবেদনশীল স্থাপনায় সয়ংক্রিয় অগ্নি সনাক্তকরণ এবং সুরক্ষা ব্যবস্থা সুদূর পরাহত।

এমনিতেই সাজেকের মতো সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে উঁচু স্থানে প্রাকৃতিক পানির উৎস না থাকায় রয়েছে পানির স্বল্পতা। এমন একটি জায়গায় এ রকম সংবেদনশীল স্থাপনা নির্মাণ করে একটি দুর্ঘটনা প্রবল অঞ্চল তৈরি করা হচ্ছে। ফলে আজ অব্দি পাঁচটি অগ্নি দূর্ঘটনা ঘটেছে। সাজেকে প্রথম অগ্নি দূর্ঘটনা ঘটেছিল ২০১৭ সালে। এরপর ২০১৮ সালে ৩টি রিসোর্ট ও রেস্তোরাঁ, ০২-১২-২০২১ এ একটি, ০২-০২-২০২৪ এ দুটি রিসোর্ট আগুনে পুড়ে ধ্বংস হয়ে যায়। সম্প্রতি ২৪-০২-২০২৫ এর অগ্নি দূর্ঘটনায় প্রায় ১৪০টি রিসোর্ট-কটেজ, রেস্তোরাঁ, দোকান ও বসতঘর সম্পূর্ণভাবে পুড়ে গিয়েছে।

অগ্নি নিরাপদ পার্বত্য ইকো রিসোর্ট বাস্তবায়নে সুপারিশ সমূহঃ
যে কোন ইকো রিসোর্ট বিশেষ করে পার্বত্য অঞ্চলের ইকো রিসোর্টে আগুন থেকে সুরক্ষা নিশ্চিত করতে টেকসই প্রযুক্তি এবং পরিবেশবান্ধব নকশার সমন্বয়ের যথেষ্ঠ প্রয়োজন রয়েছে। একজন পেশাজীবি স্থপতি হিসেবে সামাজিক দ্বায়বদ্ধতা থেকে এধরনের স্থাপনার কিছু মূল বৈশিষ্ট্য ও কৌশল এই প্রবন্ধে সুপারিশ করা হলো। এসব অনুসরন করে পরিকল্পিতভাবে যদি আমরা পার্বত্য অঞ্চলের পর্যটনকেন্দ্রসমূহ গড়ে তুলতে পারি তাহলে যেমন নান্দনিক ও নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করা যাবে একইসাথে এই খাতে দেশি এবং বৈদেশিক আয়ের সুযোগ আরো অবারিত করা সম্ভব হবে।
নির্মাণ সামগ্রীঃ
প্রথমে আশা যাক নির্মাণ সামগ্রীর বিষয়ে। আগুন প্রতিরোধের জন্য বিশেষভাবে প্রক্রিয়াজাত কাঠ বা বাঁশ এসব রিসোর্ট নির্মাণে ব্যবহার করা উচিত। কাঠ/বাঁশ/বেড়ার দেয়ালগুলোর মাঝে নিরোধক বা ইন্স্যুলেশন ব্যবহার করলে শব্দ এবং আগুন দুটোরই নিয়ন্ত্রিত পরিবহন নিশ্চিত করা যাবে। মাটির ঘর বা মাটি দিয়ে তৈরী দেয়াল ব্যবহার করলেও এর পরিবেশ বান্ধব বৈশিষ্ট্যের পাশাপাশি অগ্নি নিরোধী পরিবেশ দেয়া সম্ভব।
নবায়নযোগ্য জ্বালানীর ব্যবহারঃ
অগ্নি নিরাপত্তা নিশ্চিতে এ ধরনের স্থাপনায় নবায়নযোগ্য জ্বালানী ব্যবহারে গুরূত্ব দেয়া উচিৎ। সৌরবিদ্যুতের ব্যবহার এসব পর্যটন কন্দ্রে ব্যাপকভাবে উৎসাহিত করতে হবে। সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের মাধ্যমে লাগসই এলাকাতে বায়ু শক্তির ব্যবহারে সরকারের পক্ষ থেকে পৃষ্ঠপোষকতা করার দরকার রয়েছে।
পার্বত্য ইকো রিসোর্ট Eco Resort এর ল্যান্ডস্কেপঃ
অগ্নি নিরাপত্তা নিশ্চিতে এসব পর্যটন কেন্দ্রের ল্যান্ডস্কেপ নকশার দিকেও নজর দেয়া প্রয়োজন। এ ধরনের স্থাপনার চারপাশে প্রায় প্রতি দিনই গাছের শুকনো ঝরা পাতা জমা হয়, যা বেশ দাহ্য। তাই নিয়মিত এসব পাতা পরিষ্কার করা উচিত। আবার এসব স্থাপনার নির্দিষ্ট সীমানার মধ্যে কোন বৈশিষ্ট্যের গাছ রোপন করলে অগ্নি নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করা যাবে তার জন্য একজন অভিজ্ঞ ল্যান্ডস্কেপ স্থপতির উপদেশ নেয়া উচিৎ। এমন সব গাছ নির্বাচন করা উচিৎ যে সব গাছের পাতা সহজেই ঝরে পড়ে না (কামিনী,গর্জন, চন্দন, নারিকেল)। যে সব গাছ যথেষ্ঠ পানি ধরে রাখতে পারে (যেমন-সুপারী, রাবার, এলোভেরা, ফনিমনসা) এমন গাছও নির্বাচন করা যেতে পারে। পাথুরে হাঁটা পথ, পাথরের প্রাচীর একদিকে যেমন নান্দনিক ও প্রাকৃতিক নির্মিত পরিবেশ সৃষ্টি করবে তেমনিভাবে পাথরেরর এসব উপকরন Fire Breaker হিসেবে কাজ করে আগুন ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা হ্রাস করবে। সম্ভব হলে এসব কটেজের ছাদে গাছ লাগিয়ে যদি সবুজায়ন করা যায় তাহলে তা তাপ ও আগুন প্রতিরোধী হয়ে দৃষ্টি নন্দন স্থাপনার উদ্রেক করবে। এ ধরনের প্রাকৃতিক রিসোর্ট সেন্টার স্থাপনের ক্ষেত্রে প্রাকৃতিক পানির উৎসের ক্ষতিসাধন না করে তার কাছাকাছি স্থাপন করলে নিকটবর্তী প্রাকৃতিক পানির উৎস (পুকুর, ছড়া, প্রপাত, হ্রদ) জরুরী প্রয়োজনে কাজে আসতে পারে।
বৃষ্টি, মেঘ, কুয়াশা থেকে পানি সংরক্ষণঃ
যেহেতু সাজেকসহ অন্যান্য পার্বত্য অঞ্চলে পানির উৎসের স্বল্পতা থাকে তাই এধরনের পর্যটন কেন্দ্র স্থাপনের সময় Rain Water Harvesting বা বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ পদ্ধতিতে প্রতিটি রিসোর্টে পানির আধার তৈরি করলে জরুরী পরিস্থিতিতে সেটি আগুন নেভানোর কাজে সহায়ক হবে। আবার সম্প্রতি মেঘ/কুয়াশা থেকে পানি সংগ্রহের পরিবেশবান্ধব পদ্ধতির প্রচলন হয়েছে। এই পদ্ধতি প্রয়োগ করে আমাদের দেশের পার্বত্য অঞ্চলের পর্যটন কেন্দ্র এবং বসতবাড়িতে সুপেয় পানির ব্যবস্থা করলে এসব অঞ্চলের পানির সংকট অনেকাংশেই দূর করা সম্ভব।
সক্রিয় ও নিষ্ক্রিয় অগ্নি-নির্বাপন ব্যবস্থাঃ
সর্বোপরি, স্থায়ী উপাদানে নির্মিত স্থাপনার মতো এসব রিসোর্টেও ধোঁয়া শনাক্তকারী ও স্বংক্রিয় স্প্রিংকলার ব্যবস্থা নিশ্চিত করা, ড্রাই পাউডার বা শুষ্ক গুঁড়ো অগ্নি নির্বাপক ব্যবস্থা ব্যবহার করা যেতে পারে। জরূরী নির্গমনের নির্দেশিত পথ এবং আপদকালীন সময়ে উদ্ধারকারী যানবাহনের উপযোগী পথ তৈরিসহ সংবেদনশীল স্থানসমূহে বহনযোগ্য অগ্নি নির্বাপকের সহজলভ্যতা সঠিকভাবে নিশ্চিত করতে হবে। একইসাথে নিয়মিত অগ্নি-নির্বাপন ব্যবস্থার রক্ষণাবেক্ষণ, কর্মীদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা এবং পর্যটকদের মাঝে সচেতনতা সৃষ্টি করলে ক্ষয়-ক্ষতি বহূলাংশে কমিয়ে আনা সম্ভব।
শেষ কথাঃ
যদি পরিকল্পিতভাবে সার্বিক সমন্বয়তার মাধ্যমে আমরা পার্বত্য অঞ্চলের পর্যটনকেন্দ্রসমূহ গড়ে তুলতে না পারি তাহলে পর্যাপ্ত ফায়ার স্টেশন নির্মাণ করেও কোন ফলপ্রসূ নিরাপদ পরিবেশ পর্যটক ও এইখাতে বিনিয়োগকারীদের জন্য নিশ্চিত করা যাবে না। উপরন্তু বারংবার দূর্ঘটনা ঘটতেই থাকবে।
লেখকঃ স্থপতি মুহাইমিন শাহরিয়ার, প্রতিষ্ঠাতা, আর্ক-বাংলা ডট কম, mshahriar@arch-bangla.com
ফায়ার সেফটি বা অগ্নি নিরাপত্তা
- #eco-resort #sajek_resort #sajek_valley #SajekValley #ইকো_রিসোর্ট #ইকো_রিসোর্ট_Eco_Resort #সাজেক #সাজেক_ভ্যালী #eco_resort_fire_safety #অগ্নি_নিরাপত্তা